আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। প্রিয়াংকা নিজের জুতো খুলে খালি পায়ে ভেতর থেকে একটু ঘুরে এসে বলল, তপু, আমার আব্বু হচ্ছেন একজন। লেখক।
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম, সত্যি? হা সত্যিকার লেখক। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী নাম।
প্রিয়াংকা হি হি করে হাসল, বলল, নাম বললে তুই চিনবি না। আসলে কেউই চিনবে না। আল্লু দুই তিন বছর পরিশ্রম করে যে বই লিখে সেটা ছাপা হয় দশ কপি। যে ছাপায় সে কিনে পাঁচ কপি আর আলু কিনে পাঁচ কপি!
প্রিয়াংকার আব্বু বললেন, সেই পাঁচ কপি কিনে তোর আব্বু কী করে সেটাও বলে দে।
বাসায় যদি কেউ আসে জোর করে তাকে একটা কপি ধরিয়ে দেয়। আজকে তুই এসেছিস তোকেও আব্বুর বইয়ের এক কপি নিয়ে যেতে হবে দেখিস!
আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে প্রিয়াংকা আর তার আব্বুর দিকে তাকিয়ে রইলাম, দেখে মনে হচ্ছে দুইজন সমবয়সী বন্ধু কথা বলছে! আমার আব্বু যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে আমিও কী এভাবে কথা বলতে পারতাম?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কীসের ওপর বই লিখেন?
প্রিয়াংকার আব্বু কথা বলার আগেই প্রিয়াংকা বলল, তুই শুনলে বিশ্বাস করবি না। আব্বু যে সব বিষয়ের ওপর বই লিখে সেসব বিষয় যে আছে সেটাও তুই জানিস কী না সন্দেহ আছে!
প্রিয়াংকার আব্বু বললেন, ব্যস অনেক বাপের বদনাম করা হয়েছে। এখন তোর বিখ্যাত বন্ধুর জন্য চা-নাস্তা কিছু নিয়ে আয়।
প্রিয়াংকা বলল, আনছি বাবা আনছি।
প্রিয়াংকা রান্নাঘরের দিকে চলে যাবার পর প্রিয়াংকার আব্বু আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললেন, আমার বইগুলো হচ্ছে অবলুপ্ত প্রাণীদের ওপর।
অবলুপ্ত প্রাণী?
হ্যাঁ। আমাদের এই অঞ্চলে এক সময় গণ্ডার থাকতো তুমি জানো?
আমি জানতাম না, তাই অবাক হয়ে তাকালাম। প্রিয়াংকার আব্বু বললেন। শুধু গণ্ডার না, এখানে বনরুই বলে একটা প্রাণী থাকতো, নীল গাই নাম এক ধরনের প্রাণী থাকতো এখন সব অবলুপ্ত হয়ে গেছে, না হয় অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আমি ভাবলাম প্রাণীগুলো যখন থাকবেই না অন্তত তার ইতিহাসটা বেঁচে থাকুক। কী বলো?
আমি গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়লাম। আমি এখন আস্তে আস্তে বুঝতে পারছি প্রিয়াংকা কেমন করে প্রিয়াংকা হয়েছে! তার আব্বু আমার সাথে এমন ভাবে কথা বলছেন যেন আমি একজন বড় মানুষ। প্রিয়াংকার সাথেও নিশ্চয়ই এভাবে কথা বলেন, তাই প্রিয়াংকা নিজে বোঝার আগেই বড় হয়ে গেছে। তার। কথাবার্তা, চালচলন সব বড় মানুষের মতো। আমি আড় চোখে কয়েকবার প্রিয়াংকার আব্বুর দিকে তাকালাম, হুইল চেয়ারে তার পাগুলো দেখে মনে হয়।
সেখানে কোন সমস্যা আছে কিন্তু আসলে নিশ্চয়ই আছে। তা না হলে হুইল চেয়ারে কেন? কী হয়েছিল কে জানে!
কিছুক্ষণের মাঝেই প্রিয়াংকা চানাচুর আর চা নিয়ে এলো। এইটুকুন সময়ের মাঝে চানাচুরগুলো কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ দিয়ে মাখিয়ে নিয়ে এসেছে। ছোট একটা টেবিল ঘিরে আমরা বসেছি–আমি আর প্রিয়াংকা চেয়ারে, প্রিয়াংকার আব্বু হুইল চেয়ারে। চা খেতে খেতে প্রিয়াংকা কথা বলতে লাগলো–প্রিয়াংকার আব্বু এক সময় তাকে থামালেন, বললেন, প্রিয়াংকা তোর কথা তো প্রত্যেক দিনই শুনি–আজকে তোর গেস্টের মুখ থেকে কিছু শুনি।
প্রিয়াংকা হি হি করে হেসে বলল, তাহলেই হয়েছে। আমাদের তপু মাত্র তিনটা শব্দ জানে। একটা হচ্ছে ও, আরেকটা আচ্ছা আর আরেকটা তাই নাকী! তাই তুমি যদি তপুর কথা শুনতে চাও এই তিনটাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
প্রিয়াংকার আলু হেসে বললেন, ঠিক আছে, এই তিনটাতেই না হয় সন্তুষ্ট থাকব, কিন্তু তার মুখ থেকে শুনে সন্তুষ্ট থাকি!
প্রিয়াংকার আব্বু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, খবরের কাগজে তোমার সম্পর্কে যেটা লিখেছে সেটা পড়ে মনে হলো তুমি হয়তো একটা ইয়াং প্রডিজি। প্রডিজি কী জানো তো খুব কম বয়সে যাদের মেধার অস্বাভাবিক বিকাশ ঘটে তাদেরকে বলে প্রডিজি।
আমি অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসলাম, না–সেরকম কিছু না!
তোমার বিনয় করার প্রয়োজন নেই। দেখা গেছে গণিত সঙ্গীত এসব বিষয়ে মেধা সাধারণত খুব কম বয়সে বিকশিত হয়।
আমি বললাম, ও। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, তুমি সেটাকে কন্ট্রোল করতে পারবে তো?
কন্ট্রোল?
হ্যাঁ। প্রিয়াংকার আলু চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, আমার মেয়ে তোমাকে রাতারাতি বিখ্যাত বানিয়ে ফেলে মহাখুশি। আমার প্রশ্ন হলো সেটা তোমার জন্যে কী ভাল হলো, নাকী খারাপ হলো?
প্রিয়াংকা ঠকাস কার কাপটা টেবিলে রেখে বলল, কী বলছ তুমি আব্বু? এটা আবার খারাপ হবে কেমন করে?
আমি সেটাই বলার চেষ্টা করছি। খ্যাতি খুব বিচিত্র একটা জিনিস। এটা লটারির মতো অনেক চেষ্টা করেও এটা পাওয়া যায় না। যারা পাবার তারা এমনিতেই পায়। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার কী জানিস?
কী?
বেশিরভাগ সময়ে খ্যাতিটা অপাত্রে যায়। যারা পায় তারা সেটা ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না।
প্রিয়াংকা বলল, বুঝলি তপু, এই জন্যে আমাদের বাসায় কেউ আসতে চায় না। আসলেই আলু এমন জ্ঞানের কথা শুরু করে দেয় যে সে কোন মতে প্রাণ নিয়ে পালায়।
প্রিয়াংকার আবু বললেন, বাজে কথা বলবি না। আজকে প্রথম তুই একজন বিখ্যাত মানুষ এনেছিস। এর আগে বিখ্যাত কেউ এসেছে?
আমি অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসে বললাম, আমি মোটেও বিখ্যাত না–
প্রিয়াংকার আব্বু বললেন, কিন্তু তোমার ভেতরে বিখ্যাত হবার সবগুলো এলিমেন্ট আছে। সে জন্যে তোমাকে জিজ্ঞেস করছি যদি কখনো খ্যাতি এসে তোমার হাতে ধরা দেয়, তুমি সেটা কন্ট্রোল করতে পারবে?