আমার মাথায় যেটা আসে সেটাই বলে দিই, পঁয়ষট্টি লক্ষ চব্বিশ হাজার তিনশ বাহান্ন। উত্তরটা ভুল হলো না শুদ্ধ হলো সেইটা নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না, কিছু একটা উত্তর পেলেই তারা খুশি!
স্কুলের স্যারেরাও আমাকে আজকাল একটু ভাল চোখে দেখেন। সবচেয়ে মজা হয়েছিল সেদিন জ্যামিতি ক্লাসে, স্যার ক্লাসে এসে বললেন, আমার খুব একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে রে! তপু তুই ক্লাসটা নিতে পারবি না?
আমি বললাম, পারব স্যার। কিন্তু কেউ আমার কথা শুনবে না, খালি আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে।
স্যার বললেন, করে দেখুক। আমি টেনে কল্লা ছিঁড়ে ফেলব না!
স্যার টেনে কল্লা ছিঁড়ে ফেলবেন শোনার পরেও সবাই হাসাহাসি করলো কিন্তু তার মাঝেই আমি জ্যামিতি ক্লাসটা নিয়ে নিলাম। কঠিন কঠিন কয়েকটা উপপাদ্য বুঝিয়ে দিলাম। আমার মনে হয় সবাই বেশ ভালই বুঝেছে। দিলীপকেও দেখলাম কয়েবার মাথা নাড়ল।
আমার এরকম নতুন জীবন শুরু হওয়ায় সবচেয়ে খুশি হয়েছে প্রিয়াংকা! তার ভাঙ্গা গলা ঠিক হতে পাকা এক সপ্তাহ লেগে গেলো, কাজইে সে যে কীভাবে আমাকে আবিষ্কার করে গণিত প্রতিযোগিতায় নিয়ে গেছে এবং আমাকে চ্যাম্পিয়নদের চ্যাম্পিয়ন বানিয়ে ফেলেছে এবং এই ব্যাপারটাতে পুরো কৃতিত্বটাই যে তার এবং আমার কোনই কৃতিত্ব নই সে বিষয়টা সবার শুনতে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হলো। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হতে লাগলো আমি যেন কোরবানির গরু এবং আমার নাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে সে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এবং সবাইকে বলছে যে এরকম মোটাতাজা কোরবানির গরুটা কিনে আনার পুরো কৃতিত্বটাই তার! তবে প্রিয়াংকাকে সবাই পছন্দ করে, কাজেই সবাই তার সব কথা মেনে নেয়। আর এটা তো কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে প্রিয়াংকার আগে কেউ কোন দিন আমার সাথে ভাল করে কথাও বলে নি! সত্যিই সে আমাকে আবিষ্কার করেছে।
ক্লাসের কেউ আমার সাথে আম্মু নিয়ে কথা বলে না কিন্তু আমার ধারণা কীভাবে কীভাবে সবাই আসল ব্যাপারটা জেনে গেছে। কিন্তু আমার ধারণা এখানেও প্রিয়াংকার একটা হাত আছে, সে সবাইকে বলে রেখেছে কেউ যদি ভুলেও আমার সাথে আম্মু নিয়ে কথা বলে তাহলে সে পিটিয়ে তাদের হাটুর মালাই চাকি খুলে রাখবে।
শুধু বাসাতে আমার জীবন মোটামুটি আগের মতোই থেকে গেল। একেবারে কিছু পরিবর্তন হয় নাই তা নয়, আমাকে আর বাথরুম ধুতে হয় না, দুলি খালাকে রান্নাবান্নায় সাহায্যও করতে হয় না। আগে স্কুলে বেতনের জন্যে অনেক আগে থেকে আপুর পিছনে পিছনে ঘুরতে হতো, এখন আপু নিজেই একটা খামে করে বেতনের টাকাটা দিয়ে যায়। অথচ মজার ব্যাপার হলো আমাকে স্কুলে আর বেতন দিতে হয় না। শুধু যে বেতন দিতে হয় না তা নয়। উল্টো আমাকে মাসে মাসে তিনশ টাকা বৃত্তি দেয়া হয়। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আমাকে ডেকে একদিন জিজ্ঞেস করলেন আমি টিউশানি করাতে রাজি আছি কী না। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে একটা ভাল ছাত্র ম্যাথমেটিক্সের একটা টিউটর। খুঁজছে। যদি এই টিউশানিটা পেয়ে যাই তাহলে প্রতি মাসে কমপক্ষে নিশ্চয়ই দুই হাজার টাকা করে পাব। ইংলিশ মিডিয়ামে যারা পড়ে তাদের কাছে টাকা নাকী হাতের ময়লা!
প্রিয়াংকা আগের মতোই আছে। এখনো সে গোপনে বিক্ষিপ্তভাবে আনন্দ বিতরণ করে যাচ্ছে! এগুলো গোপনীয় হলেও সে মাঝে মাঝে আমাকে বলে। আমি তার সাথে যেতে চাইলে আমাকে নিয়েও যায়। একদিন একটা থুত্থুড়ে বুড়োকে একটা দাবার বোর্ড আর খুঁটির প্যাকেট দিয়ে ফিরে আসছে, তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, তুই যে এভাবে একলা একলা জায়গায়-অজায়গায় ঘুরে বেড়াস তোর বাসা থেকে কিছু বলে না?
প্রিয়াংকা রেগে বলল, আমি মোটেও জায়গায়-অজায়গায় ঘুরে বেড়াই।
আচ্ছা ঠিক আছে–ঠিক আছে। আমি নিজেকে শুদ্ধ করে বললাম, তুই যে একলা একলা নানারকম ইন্টারেস্টিং জায়গায় ঘুরে বেড়াস–তোকে বাসা। থেকে কিছু বলে না?
উঁহু।
তোর আব্বু-আম্মু দুজনেই তোকে এভাবে ঘুরে বেড়াতে দেয়?
আমার আম্মু নেই।
ও। আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। ইতস্তত করে বললাম, তোর আব্বু?
আল্লু আছেন। ও।
আমরা দুজন কিছুক্ষণ নিঃশব্দে হাঁটলাম। একসময় প্রিয়াংকা বলল, আমার বাসার কাছাকাছি চলে এসেছি। যাবি?
আমি তাকিয়ে দেখলাম, সত্যিই তাই। জিজ্ঞেস করলাম, তোর আব্বু কী বাসায় আছেন?
আছেন। সব সময়ে থাকেন।
আ-আমাকে দেখে রাগ হবেন না তো?
প্রিয়াংকা হি হি করে হাসলো, বলল, ধুর গাধা, রাগ হবেন কেন?
আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, না মানে ইয়ে
আমরা আরো কিছুক্ষণ হাঁটলাম, সরু একটা রাস্তার পাশে পুরানো একটা বাসার সামনে দাড়িয়ে প্রিয়াংকা বলল, এই যে আমাদের বাসায় এসে গেছি।
আমি বললাম, ও। প্রিয়াংকা দরজায় শব্দ করল। কয়েক মিনিট পরে ঘুট করে শব্দ করে দরজা খুলে গেলো। আমি দেখলাম হুইল চেয়ারে বসে থাকা একজন মানুষ। মানুষটার চেহারা খুব সুন্দর, এক মাথা কালো চুল, কানের কাছে সেই চুলে পাক ধরেছে। চোখে পাতলা ধাতব রিমের একটা চশমা। প্রিয়াংকা একটু আগে বলেছিল তার আব্লু সবসময় বাসায় থাকেন, এখন তাকে দেখে বুঝতে পারলাম কেন। হুইল চেয়ারে করে কোথায় আর যাবেন?
প্রিয়াংকা বলল, আব্বু, দেখো একজন গেস্ট এসেছে।
প্রিয়াংকার আব্বু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাদের বিখ্যাত গণিতবিদ?
হ্যাঁ, আব্বু।
ভেরি গুড। এসো তপু এসো। প্রিয়াংকার কাছে তোমার অনেক গল্প শুনেছি। পত্রিকায় তোমার ছবি দেখে ভেবেছিলাম তুমি আরো বড়! তুমি তো আসলে অনেক ছোট।