গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আমি চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি আবছা। অন্ধকারে আম্মু আমার সামনে দাড়িয়ে আছেন। আম্মুর হাতে একটা লোহার রড-হঠাৎ করে আমার বুকটা ধ্বক করে উঠল। আম্মুর চুল এলোমেলো, চোখগুলো অন্ধুকারেও ধ্বকধ্বক করে জ্বলছে। আম্মু হিংস্র গলায় বললেন, তোর সাহস বেশি হয়েছে তপু?
আম্মু কিসের সাহসের কথা বলছেন আমি বুঝতে পারলাম না, তাই সব সময় যেটা করি সেটাই করলাম। একটা কথাও না বলে চুপ করে বসে রইলাম। আম্মু বললেন, টেলিভিশনে বলেছিস তোর ফেমিলির সবাই তোকে পড়াশোনায় উৎসাহ দেয়?
আমি সেটা বলেছি! টেলিভিশনের লোকেরা আমার কাছে সেটাই শুনতে চেয়েছিল তাই বলেছি। আম্মু দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, তুই আমাদেরকে নিয়ে টেলিভিশনে টিটকারি মারিস? তোর এত বড় সাহস? আমি তোক খুন করে ফেলব আজকে?
আম্মু হাতের রডটা উপরে তুললেন, আমি কখনো আম্মুর সাথে কথা বলি, নিঃশব্দে মার খেয়ে যাই। আজকে কী হলো জানি না আমি হঠাৎ কথা বলতে শুরু করলাম, বললাম, আম্মু!
কী বলতে চাস?
আসলেই আমি তোমার কাছ থেকে উৎসাহ পাই আম্মু।
আমার কাছ থেকে উৎসাহ পাস? আমি কী করেছি তোর জন্যে যে তুই উৎসাহ পাস? আম্মু রডটা ঝাকালেন, আমি জানি, এক্ষুণি আমার মাথায় নেমে আসবে সেটা।
আমি কাতর গলায় বললাম, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন তুমি আমাকে কতো আদর করতে মনে আছে? আমার যখন মন খারাপ হয় তখন আমি সেই সময়ের কথা ভাবি আর আমার মন ভাল হয়ে যায়! আমি এখনোও সেই সময়ের কথা চিন্তা করে উৎসাহ পাই আম্মু।
আম্মু নিঃশব্দে দাড়িয়ে রইলেন, আমি ফিসফিস করে বললাম, এখন তুমি আমাকে যাই কর না কেন ছোট থাকতে আমাকে যে আদর করেছিলে সেটা। কেউ আমার কাছ থেকে নিতে পারবে না। বিশ্বাস করো তুমি।
আম্মু কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর নিঃশব্দে লোহার রডটা নামিয়ে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
আমি চুপচাপ আমার বিছানায় বসে রইলাম। এর আগে সবসময় আমার নিজের জন্যে মায়া হয়েছে আজকে কী হলো কে জানে হঠাৎ করে আমার আম্মুর জন্যে মায়া হতে শুরু করল।
০৯. বন্ধু এবং বন্ধু
আমি যখন পরদিন স্কুলে গেলাম তখন ক্লাসের সবাই ভিড় করে দাড়িয়েছিলআমাকে কেউ বলে দেয় নি কিন্তু আমি দেখেই বুঝতে পারলাম আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমাকে দেখে সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠল, কোন সন্দেহ নেই যে সবচেয়ে জোরে চিৎকার করছে প্রিয়াংকা, কিন্তু তার গলায় এখনো কোন শব্দ নেই। মোটাসোটা কয়েকজন আমাকে কীভাবে কীভাবে জানি ঘাড়ে তুলে ফেলল। অন্যেরা আমাকে ঘিরে লাফাতে লাগলো। মৌটুসি কোথা থেকে জানি কয়েকটা ফুল নিয়ে এসেছে, সেগুলো ছিঁড়ে পাপড়িগুলো সবাই মিলে আমার ওপর ছিটাতে শুরু করলো। আমি মেডেলটা পকেটে করে নিয়ে এসেছিলাম, সেটা টের পেয়ে জয়ন্ত পকেট থেকে বের করে নিয়ে এসেছে, সবাই সেটা গলায় দিয়ে লাফালাফি করতে লাগলো। সেখানেই শান্ত হলো না, আমাকে ঘাড়ে নিয়ে তারা স্কুলের মাঠে চলে গেলো, সেখানে কয়েকজন আমাকে ঘাড়ে নিয়ে স্কুলের মাঠে চক্কর দিতে লাগলো–অন্যেরা চিৎকার করতে করতে পিছনে পিছনে ছুটতে লাগলো। স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের আনন্দ হলো সবচেয়ে বেশি তারা পিছনে পিছনে ছুটতে লাগলো আর চিৎকার করে বলতে লাগলো, অঙ্ক ভাই, অঙ্ক ভাই, অঙ্ক ভাই অঙ্ক ভাই…চেঁচামেচি হৈচৈ শুনে স্যার আর ম্যাডামরা বের হয়ে এলেন, বের হয়ে এই দৃশ্য দেখে সবাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাসতে লাগলেন।
স্কুলের এসেম্বলিতে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম গণিত প্রতিযোগিতা নিয়ে দুই একটি কথা বললেন। তখন ক্লাস থ্রির যে মেয়েটা পুরস্কার পেয়েছে তাকে আর আমাকে সামনে ডেকে আনা হলো। স্কুলের দপ্তরি কয়েকটা খবরের কাগজ নিয়ে দাড়িয়ে ছিল, প্রিন্সিপাল ম্যাডাম সেখান থেকে কিছু কিছু জায়গা পড়ে শোনালেন। আমার জন্যে সারা দেশে আমাদের স্কুলের সুনাম কেমন বেড়ে গেছে সেটা বলার পর সবাই হাততালি দিতে লাগলো। আমি আড়চোখে রাজাকার স্যারকে দেখার চেষ্টা করলাম, মাত্র কয়দিন আগেই রাজাকার স্যার টি.সি. দিয়ে আমাকে বিদায় করে দেবার কথা বলেছিলেন, তা না হল নাকী পুরো স্কুলের বেইজ্জতি হবে! এখন রাজাকার স্যার কী বলবেন?
গণিত প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়নদের চ্যাম্পিয়ন হবার পর একেবারে ম্যাজিকের মতো স্কুলে আমার অবস্থাটা পাল্টে গেলো। আগে আমাকে দেখলে ছেলেমেয়েরা দূরে সরে যেতো, এখন আমাকে দেখলেই সবাই দাত বের করে হেসে বলে, কী খবর আইনস্টাইন? আজকে কোন কিছু আবিষ্কার হলো? আমি তাদের অনেকবার বলেছি আইনস্টাইন হচ্ছেন একজন বৈজ্ঞানিক–গণিতবিদ না, কিন্তু কোন লাভ হয় নাই। আগে মেয়েরা আমাকে রীতিমতো ভয় পেতো, চোখ পাকিয়ে কারো দিকে তাকালেই মনে হতো এখনই ভ্যা করে কেঁদে দিবে। এখন আমাকে ভয় তো পায়ই না উল্টো আমার সাথে গল্প করার জন্যে চলে আসে! এলজেবরা জ্যামিতি বা ত্রিকোণমিতির কোন কিছু না বুঝলেই এখন তারা আমার কাছে চলে আসে, আমাকে সেগুলো বুঝিয়ে দিতে হয়। মেয়েগুলি দুষ্টও কম না, বেশি সময় থাকার জন্যে অনেক সময় বুঝেও না বোঝার ভান করে! তবে সবচেয়ে মজা হয় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাদের ধারণা আমি ভাল অঙ্ক জানি, তার মানে আমি নিশ্চয়ই বড় বড় গুণ করতে পারি। দেখা হলেই বলে, অঙ্ক ভাই, অঙ্ক ভাই, সাতশ তেইশ আর নয় হাজার চব্বিশ গুন করলে কতো হয়?