আবার কথা শোনা যেতে লাগলো, অনুষ্ঠান শেষে একান্ত সাক্ষাৎকারে আমাদের ক্ষুদে গণিতবিদ আরিফুল ইসলাম তপু জানান আমি তখন হঠাৎ করে আমার নিজের গলার স্বর শুনতে পেলাম, আমি বলছি, না মানে আমি কখনই ভাবি নাই আমি চ্যাম্পিয়নদের চ্যাম্পিয়ন হব। সবাই ছয়টা সাতটা করে অঙ্ক করেছে আমি করেছি মাত্র একটা! আমি বুঝি নাই আমি যেটা করেছি সেটা ছিল সবচেয়ে কঠিন। তবে অঙ্কটা কঠিন হলেও খুব মজার অঙ্ক ছিল। আমার করতে খুব মজা লেগেছে। আমার কথা যখন বলেছে তখন টেলিভিশনে নিশ্চয়ই আমাকে দেখিয়েছে–কেমন দেখাচ্ছিল কে জানে! ইস যদি একবার দেখতে পারতাম!
টেলিভিশনে আবার কথা শোনা যেতে লাগলো, আমাদের ক্ষুদে গণিতবিদ আরিফুল ইসলাম তপু জানিয়েছে সে বড় হয়ে একজন সত্যিকার গণিতবিদ হতে চায়। সে জানায় তার সাফল্যের পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে তার বন্ধুবান্ধব, তার স্কুলের শিক্ষক এবং অবশ্যই তার পরিবারের সদস্যরা।
খবরের মানুষটি বলল, এবারে খেলার খবর। তখন একটা বাজনা বাজতে লাগলো। এখন মনে হয় বিজ্ঞাপন শুরু হয়ে যাবে।
আমি কিছুক্ষণ রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে রইলাম, বসার ঘর থেকে আম্মু ভাইয়া বা আপুর কোন কথা শোনা যায় কী না সেটা শুনতে। কিন্তু কিছু শুনতে পেলাম না। সবাই নিঃশব্দে বসে আছে। এই মুহূর্তে কী ভবছে তারা? আমি নিঃশব্দে আবার স্টোররুমে আমার বিছানায় ফিরে এলাম।
অন্যদিন খাবার টেবিলে আম্মু ভাইয়া আর আপু হালকা গলায় একটু কথাবার্তা বলে আজকে আমি এটা কথাও শুনতে পেলাম না, একেবারে নিঃশব্দে তারা খেয়ে উঠে গেলো। আমি শুনতে পেলাম সবাই নিজের নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করেছে।
ঠিক আধাঘণ্টা পরে বাসার কলিংবেল বেজে উঠল। আমাদের বাসায় খুব বেশি কেউ আসে না–আম্মুর অফিসের লোকজন, ভাইয়া বা আপুর দুই একজন বন্ধুবান্ধব মাঝে মাঝে আসে। তারা অবশ্যি আরো আগে আসে–এখন একটু বেশি রাত হয়ে গেছে। কলিংবেল শুনে দুলি খালা দরজা খুলে দিয়েছে, আমি একজন মহিলার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। আমি কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম কে এসেছে, কার কাছে এসেছে। কিছু বোঝার আগেই আমি পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম, রান্নাঘর হয়ে স্টোররুমে যে এসে হাজির তাকে দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম, আমাদের প্রিন্সিপাল ম্যাডাম। ম্যাডামের হাতে একটা বিশাল ফুলের তোড়া।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম স্টোররুমে এসে চালের বস্তাটা ঠেলে সরিয়ে একটু জায়গা করে নোংরা মেঝেতে বসে পড়লেন। তাকে দেখে মনে হলো স্টোররুমের ছোট ঘুপচিতে ময়লা তোষক বিছিয়ে গুটিশুটি মেরে একজনের ঘুমানো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার আর ফুলের তোড়া নিয়ে তার সাথে দেখা করতে আসা আরো স্বাভাবিক ব্যাপার। ম্যাডাম ফুলের তোড়াটা আমার বিছানায় রেখে বললেন, টেলিভিশনে এই মাত্র তোমাকে দেখেছি। আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। তোমার মেডেলটা আমাকে দেখাও, নিজের চোখে না দেখলে আমার বিশ্বাস হবে না।
আমি তখনও থতমত খেয়ে আছি। কী হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছি না। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কেমন করে আমার বাসায় এতো রাতে চলে এলেন, কেন এলেন? বাসার কারো সাথে কথা না বলে এই স্টোররুমে কেন চলে এলেন। আমাদের এভাবে দেখে একটুও অবাক কেন হচ্ছেন না কেন ভান করছেন এটাই স্বাভাবিক? আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, ম্যাডাম-আ-আপনি আমার বাসা চিনলেন কেমন করে ম্যাডাম?
যতদিন আমাদের ভ্রাম্যমাণ এনসাইক্লোপিডিয়া প্রিয়াংকা আছে ততদিন তোমার বাসা চেনা কোন সমস্যা নাকী? প্রিন্সিপাল ম্যাডাম শব্দ করে হেসে বললেন, আজ বিকেলে সে আমার বাসায় হাজির! শুধু লাফঝাপ দেয় আর ঠোঁট নাড়ায়–গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হয় না। শুধু ফাস ফাস করে শব্দ হয়! অনেক কষ্ট করে আমাকে বুঝিয়েছে। তার সাথে বসে টেলিভিশনের নিউজ দেখে এখন আসছি!
হঠাৎ করে আমার অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে গেল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কেন সোজা স্টোররুমে চলে এলেন, কেন আমাকে ময়লা তোষকের মাঝে গুটিশুটি মেরে বসে থাকতে দেখেও অবাক হলেন না–সব আমি বুঝে গেলাম। আমি নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলাম, প্রিয়াংকা কোথায় ম্যাডাম?
বাইরে ঘোরাঘুরি করছে! ভিতরে আসতে রাজি হলো না। আমি বললাম, ও।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আমার মাথায় হাত রাখলেন, তারপর নরম গলায় বললেন, তপু, তুমি একা একা অনেক দূর চলে এসেছ। এরকম আমি কখনো দেখি নি। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি তোমার আর একা একা যেতে হবে না। আমরা সবাই থাকব তোমার সাথে।
আমি কোন কথা বললাম না। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম উঠে দাড়ালেন, তারপর স্টোররুম থেকে বের হয়ে গেলেন। বাইরে নিশ্চয়ই আম্মুর সাথে দেখা হলো কারণ শুনলাম প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, আপনি নিশ্চয়ই তপুর আম্মু? আমরা সবাই তপুকে নিয়ে খুব গর্বিত। এমন একটি সন্তানকে আপনি জন্ম দিয়েছেন–আপনি হচ্ছেন রত্নগর্ভা।
আম্মু কিছু বললেন না। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, অসময়ে আপনাদের বিরক্ত করলাম, কিছু মনে করবেন না। খবরটা শুনে আর বাসায় থাকতে পারলাম না।
আম্মু এবারে অস্পষ্ট গলায় কী যেন বললেন। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, আসি তাহলে?
দরজা খোলা এবং বন্ধ হবার শব্দ শুনতে পেলাম–প্রিন্সিপাল ম্যাডাম নিশ্চয়ই চলে গেলেন। আমি দীর্ঘ সময় নিঃশব্দে আমার ঘরে বসে রইলাম, আমার শুধু মনে হতে লাগলো এক্ষুণি হয়তো আম্মু আমার ঘরে আসবেন–কিছু একটা বলবেন, কিন্তু আম্মু আসলেন না।