প্রেসিডেন্ট চলে যাবার পরও আমাকে বেশ কিছুক্ষণ প্যান্ডেলে থাকতে হলো। রাগী রাগী চেহারার বুড়ো মানুষগুলো সবাই এসে আমার সাথে কথা বলল, আমার নাম-ঠিকানা কাগজে লিখে নিল। সাংবাদিকরা আমার সাথে কথা বলল, আমি কী করি, কী খাই, কী পরি এরকম নানা রকম প্রশ্ন করলো। টেলিভিশনের লোকেরা আমার ইন্টারভিউ নিলো। কয়েকজন মা তাদের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েকে আমার পাশে দাড় করিয়ে ছবি নিলেন। প্রায় আমাদের বয়সী কয়েকটা মেয়ে তাদের খাতায় আমার অটোগ্রাফ নিয়ে আমার টেলিফোন নম্বর জানতে চাইলো। আমি টেলিফোন নম্বর দেবার সাহস করলাম না। জয়ন্ত, মামুন, মৌটুসি আর আমাদের স্কুলের অন্যেরাও আমার আশেপাশে দাড়িয়ে রইলো। তারা এমন ভাব করতে লাগলো যেন তারা সব সময়েই জানতো আমি অসাধারণ প্রতিভাবান। সাংবাদিকেরা যখন তাদের ইন্টারভিউ নিলো তারা বানিয়ে বানিয়ে আমার সম্পর্কে অনেকগুলো ভাল ভাল কথা বলে ফেললো।
বেচারি প্রিয়াংকা শুধু একটা কথাও বলতে পারল না। তার গলা দিয়ে একটা শব্দও বের হচ্ছে না।
আমি যখন বাসায় ফিরে এসেছি তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। আমি সাবধানে বাসার ভিতরে ঢুকলাম, আম্মু বসার ঘরে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। সামনে টেলিভিশনটা খোলা, কিছু একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে, আপু সেটা দেখছে। ভাইয়া মনে হয় তার ঘরে।
আমি নিঃশব্দে রান্নাঘরে এসে ঢুকলাম, দুলি খালা রান্না করছিল, মাথা ঘুরিয়ে আমাকে দেখে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল। আমি দুলি খালার কাছে গিয়ে পকেট থেকে আমার গোল্ড মেডেলটা বের করে দেখালাম, বললাম, এই দেখো দুলি খালা।
এইটা কী?
মেডেল।
কই পাইছ?
আমাকে দিয়েছে।
কে দিল?
প্রেসিডেন্ট।
দুলি খালা কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, কুন জায়গার প্রেসিডেন্ট?
কোন জায়গা মানে কী? বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট।
স্বয়ং বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট আমাকে একটা মেডেল দিয়েছেন শুনেও দুলি খালার খুব একটা ভাবান্তর হলো না। সে মেডেলটা হাতে নিয়ে বলল, কীসের মেডেল এইটা? পিতলের?
আমি হেসে বললাম, ধুর দুলি খালা! পিতল হবে কেন? এইটা সোনার মেডেল!
আসল সোনা?
হ্যাঁ। আসল। একটা দেশের প্রেসিডেন্ট কখনো নকল সোনা দেয় নাকী?
দুলি খালার এইবার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। মেডেলটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলো, কতটুকু ওজন অনুমান করে বলল, দুই ভরির কম না। কমপক্ষে দশ হাজার টাকা!
সত্যি?
হ্যাঁ। সোনার কতো দাম তুমি জানো?
দুলি খালা মেডেলটা হাতে নিয়ে নানা ভাবে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলো এবং খাঁটি সোনা আর নকল সোনার পার্থক্য কীভাবে ধরতে হয় সেটা নিয়ে কথা। বলতে লাগলো। কেন এই মেডেলটা পেয়েছি জানার খুব এটা আগ্রহ দেখালো না। এক দিক দিয়ে ভাল, যদি আগ্রহ দেখাতো তাহলে দুলি খালাকে সেটা বোঝাতে পারতাম বলে মনে হয় না! নাচের কম্পিটিশন হয়, গানের কম্পিটিশন হয় এমন কী কবিতা আবৃত্তির কম্পিটিশন হয়। তাই বলে গণিতের কম্পিটিশন?
স্টোররুমে আমি আমার বিছানায় শুয়ে শুয়ে সার্টিফিকেটটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম। মেডেলটা হাতে নিয়ে দেখলাম, তারপর সেগুলো তোশকের নিচে রেখে দিয়ে চুপচাপ শুয়ে রইলাম। আম্মু, ভাইয়া কিংবা আপু কিছুই জানে না। কালকে নিশ্চয়ই খবরের কাগজে খবরটা ছাপা হবে, সেই খবরটা পড়ে আম্মু কী করবে? ভাইয়া আর আপুইবা কী করবে? তাদের সবার ধারণা আমি একজন অপদার্থ খারাপ ছেলে। আমাকে দিয়ে কিছু হবে না! খবরের কাগজে যখন দেখবে বাংলাদেশে আমার মতো গণিত কেউ জানে না—আমি হচ্ছি চ্যাম্পিয়নদের চ্যাম্পিয়ন তখন তারা কী করবে?
আমার সেই ছোটবেলার কথা মনে হলো। স্কুল থেকে ডিবেটের টিম গিয়েছে, আমিও আছি সেই টিমে! আম্মু আমাকে নিয়ে গেছেন, বসেছেন দর্শকদের সাথে। ডিবেটে যখন আমাদের টিম জিতে গেলো তখন আম্মুর সে কী হাততালি। মেডেলটা নিয়ে যখন এসেছি আম্মু আমাকে ধরে সবার সামনে দুই গালে চুমু খেয়ে ফেললেন! বাসায় যখনই কেউ এসেছে সাথে সাথে তাদের আমার সেই মেডেলটা দেখিয়েছেন, এখন আমি বাংলাদেশের গণিত প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়নদের চ্যাম্পিয়ন হয়েছি, দেশের প্রেসিডেন্ট আমাকে একটা গোল্ড মেডেল দিয়েছে কিন্তু আমি সেটা আম্মুকে বলতে পারছি না।
আম্মু আর আপু বসার ঘরে বসে টেলিভিশন দেখছিল। এখন ভাইয়ার গলাও শুনতে পাচ্ছি, তিনজনে মিলে টেলিভিশনে খবর শুনছে। আজকে মনে হয় ক্রিকেট খেলা ছিল, ক্রিকেট খেলা নিয়ে বাসার সবার খুব উৎসাহ। যখনই ক্রিকেট খেলা হয় তখন সবাই মিলে সেটা দেখে। আমি অন্যমনস্কভাবে বসার ঘর থেকে টেলিভিশনের খবরের ছিটে ছোটা শুনছিলাম হঠাৎ ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠলাম। টেলিভিশনে আজকের গণিত প্রতিযোগিতার কথা বলছে! আমি পা টিপে টিপে রান্নাঘরের দরজা পর্যন্ত চলে এলাম ভাল করে শোনার জন্যে। দুলি খালা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো, আমি ফিসফিস করে বললাম, দুলি খালা, টেলিভিশনে আমাদের খবর বলছে।
দুলি খালা তখন চুলো থেকে ডেকচিটা নামিয়ে হাত মুছে তাড়াতাড়ি বসার ঘরে গেলো খবর শুনতে। আমি দরজায় কান লাগিয়ে খবরটা শোনার চেষ্টা করতে লাগলাম। আবছা আবছা শুনতে পেলাম খবরে বলছে, এই গণিত প্রতিযোগিতায় সারা দেশ থেকে প্রায় দেড় হাজার প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করে। প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার দেওয়ার সময় রাষ্ট্রপতি বলেন, আজকের শিশু-কিশোররাই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের কর্ণধার। তারাই একদিন বড় বিজ্ঞানী। এবং গণিতবিদ হয়ে এই দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। এই গণিত প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়নদের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে একমাত্র স্বর্ণপদকটি পেয়েছে হয় বি.কে. হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র আরিফুল ইসলাম তপু। খবর এক মুহূর্তের জন্যে। থেমে যায় এবং অনেক মানুষের হাততালি শোনা যেতে থাকে, এখন নিশ্চয়ই দেখাচ্ছে আমাকে গোল্ড মেডেলটি দেয়া হচ্ছে! ইস! আমি যদি একবার দেখতে পারতাম!