সবার শেষে প্রেসিডেন্ট বক্তৃতা দিতে উঠলেন, তিনি অল্প কথায় বেশ গুছিয়ে বক্তৃতা দিলেন। গণিত কী রকম জরুরি, আজকের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যে ভবিষ্যতের বড় বড় বিজ্ঞানী হবে এরকম খুব ভাল ভাল কথা বললেন। বক্তৃতা শেষ হবার পর সবাই খুব জোরে জোরে হাততালি দিলপ্রেসিডেন্ট বক্তৃতা শেষ করার পর মনে হয় জোরে জোরে হাততালি দেওয়ার নিয়ম।
হালকা-পাতলা মেয়েটা বলল এখন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানটা পরিচালনা করার জন্যে গণিতের একজন প্রফেসরকে অনুরোধ করল। মানুষটার উষ্কখুষ্ক চুল, বড় বড় গোঁফ। মোটামুটি সেজেগুজে এসেছে। তবু তার চেহারায় ভদ্রলোকের ভাবটা ফুটে ওঠে নি। মানুষটা স্টেজে উঠে প্রথমে গণিত কী রকম কঠিন সেটা নিয়ে একটা রসিকতা করল, কেউ একটুও হাসল না, তাতে একটা লাভ হলো, মানুষটা আর রসিকতা করার চেষ্টা না করে পুরস্কার নেওয়ার জন্যে একজন একজন করে ডাকতে লাগলো।
প্রথমে প্রাইমারি ক্লাস, তারপর জুনিয়র তারপর আমাদের গ্রুপ। সবশেষে কলেজ। দলভিত্তিক পুরস্কার, একক পুরস্কার। আমাদের স্কুল থেকে প্রাইমারি গ্রুপের একটা মেয়ে দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়ে গেলো আমরা সবাই তখন জোরে জোরে হাততালি দিলাম।
সব পুরস্কার দেওয়া শেষ, এখন কেউ একজন সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করে দেবে তারপর প্রেসিডেন্ট চলে গেলে আমারা বাসায় যেতে পারব। ঠিক কী কারণ জানি না আমার ভেতরটা তেতো হয়ে আছে। আমার মনে হচ্ছে কিছু একটা ঠিকভাবে হয় নি, কোনটা ঠিকভাবে হয় নি সেটা বুঝতে পারছি না বলেই মেজাজটা আরো বেশি খারাপ হয়ে আছে। উষ্কখুষ্ক চুলের গণিতের প্রফেসর তখন হঠাৎ এমন ভাব করল যেন তার কিছু একটা মনে পড়েছে। হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আমরা এতক্ষণ প্রথম দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চ্যাম্পিয়নদের পুরস্কার দিয়েছি। এখন আমাদের সর্বশেষ পুরস্কার চ্যাম্পিয়নদের চ্যাম্পিয়ন।
আমি তখন লক্ষ করলাম সত্যিই টেবিলে এখনো একটা পুরস্কার রয়ে গেছে। গণিতের প্রফেসর হাত থেকে একটা কাগজ বের করে বলল, পুরস্কারটা যাবে সেকন্ডারি গ্রুপে। এই পুরস্কারটা পেয়েছে এমন একটা ছেলে যে এখনই আমার থেকে বেশি গণিত জানে! সব গ্রুপে আমরা একটা করে গণিতের সমস্যা দিয়েছি যেটা এতো কঠিন যে দুই ঘন্টার মাঝে করা সম্ভব নয়। সেকন্ডারি গ্রুপের এই অঙ্কটা আমি করেছি দুই দিনে, তাও অন্য অনেকের সাহায্য নিয়ে। কিন্তু আজকে একজন ছেলে সেই অঙ্কটি করে ফেলেছে। আমাদের কম্পিটিশনে সবগুলো অন্ধে যত মার্কস ছিল ঐ একটিতে ছিল তার। দ্বিগুণ মাকর্স! এই ছেলেটি আর কোন অঙ্ক স্পর্শ করে নি, সে শুধু ঐ একটি অঙ্ক করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। তাকে আমি মঞ্চে এসে চ্যাম্পিয়নদের চ্যাম্পিয়ন। হিসেবে স্বর্ণপদক নেওয়ার জন্যে অনুরোধ করছি।
ঠিক জানি না কেন হঠাৎ করে আমার চোখে পানি এসে গেলো। আমি শুনলাম উষ্কখুষ্ক চুলের গণিতের প্রফেসর বলছেন, ছেলেটি বি.কে, হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র আরিফুল ইসলাম তপু।
দর্শকদের ভেতরে কে যেন চিলের মতো শব্দ করে চিৎকার করে উঠল আমি না দেখেই বুঝতে পারলাম সেটা প্রিয়াংকা। সে চিৎকার করেই যাচ্ছে, অন্যদের প্রচণ্ড হাততালিতে সেটা আর শোনা যাচ্ছে না তবু সে থামছে না। গণিতের প্রফেসর তখনো আমাকে খুঁজছেন, মাইকে বলছেন, কোথায়। আরিফুল ইসলাম তপু? রেজিস্ট্রেশন নম্বর সাত এক চার তিন?
আমি যখন উঠে দাঁড়ালাম আমার পাশে যারা বসেছিল তারা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। একজন হাত বাড়িয়ে জোরে জোরে আমার সাথে হ্যান্ডশেক করল, অন্যেরা তাড়াতাড়ি সরে গিয়ে আমাকে মঞ্চে যাবার জন্যে জায়গা করে দিল। আমি আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে মঞ্চে যাচ্ছি, আমার মনে হচ্ছে সবকিছু যেন একটা অবাস্তব স্বপ্ন! চারপাশে সব কিছু কেমন যেন দুলতে লাগলো, আমি সব কিছু দেখেও দেখছি না। সবাই আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়েছে, দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে, দিচ্ছে তো দিচ্ছেই, থামার কোন নাম-নিশানা নেই। আমি তার ভিতরে প্রিয়াংকার চিৎকার শুনতে পাচ্ছি, সে কোথায় আছে কে জানে?
আমাকে কয়েকজন মঞ্চে নিয়ে গেলো। প্রেসিডেন্ট আমাকে মেডেলটা পরিয়ে দিলেন, মনে হলো কয়েকশ ক্যামেরার ফ্লাশ জ্বলে উঠলো। সত্যি সত্যি কিছুক্ষণের জন্যে আমার চোখ ধাধিয়ে গেলো। আমাকে সার্টিফিকেট দেবার সময় প্রেসিডেন্ট সেটা কিছুক্ষণ ধরে রাখলেন যেন ক্যামেরাম্যানরা ভাল করে ছবি তুলতে পারে। তারপর প্রেসিডেন্ট আমার সাথে হ্যান্ডশেক করলেন, মঞ্চে যারা বসে আছে তারাও দাঁড়িয়ে গেছে আমার সাথে হ্যান্ডশেক করার জন্যে। আমার একজন একজন করে সবার সাথে হ্যান্ডশেক করতে হলো, উষ্কখুষ্ক চুলের গণিতের প্রফেসর হ্যান্ডশেক করেই শান্ত হলেন না, আমার সাথে কোলাকুলি করে ফেললেন।
আমি যখন মঞ্চ থেকে নেমে আসছি তখনও টেলিভিশনের ক্যামেরাগুলো আমার পিছনে পিছনে আসছে। প্যান্ডেলের মাঝামাঝি আসার পর দেখলাম কে যেন দর্শকদের ঠেলে আমার কাছে ছুটে আসছে। মিলিটারিরা তাকে থামানোর চেষ্টা করল, সে কনুই দিয়ে মিলিটারিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে আমার কাছে ছুটে এলো। মানুষটি যে প্রিয়াংকা সেটা আমি অনুমান করতে পারছিলাম। কাছে এসে আমাকে ধরে কী যেন বলতে লাগলো, আমি বুঝতে পারলাম না। তার শুধু ঠোঁট নড়ছে কিন্তু গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। চিৎকার করতে করতে সে তার গলা ভেঙ্গে ফেলেছে।