মানুষটা নাম লেখার জন্যে খাতাটা ফিরিয়ে দিল–একবার ভাবলাম লিখব–লিখে লাভ কী? কিন্তু মানুষটা দাড়িয়ে আছে তাই লিখতে হলো।
পরীক্ষার হল থেকে বের হতেই আমার প্রিয়াংকার সাথে দেখা হলো, সে এক বান্ডিল কাগজ নিয়ে কোথায় জানি ছুটে যাচ্ছিল। আমাকে দেখে দাড়িয়ে, গেলো, চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করলো, কেমন হয়েছে?
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। আমতা আমতা করে বললাম, না, মানে ইয়ে–হঠাৎ করে দেখি সময় শেষ হয়ে গেল।
কয়টা করেছিস?
এ-একটা।
প্রিয়াংকার মুখটা দপ করে নিভে গেলো। শুকনো মুখে বলল, মাত্র একটা? সবাই যে বলছে খুব সোজা হয়েছে প্রশ্ন?
হ্যাঁ মানে ইয়ে–আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। ইচ্ছে হলো নিজের পিছনে একটা লাথি মারি! যদি শুধু সোজা প্রশ্নগুলো দিয়ে শুরু করতাম তাহলে আমিও অনেকগুলো করে ফেলতে পারতাম।
প্রিয়াংকা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, যাই হোক। পরের বার ভাল করে করবি। আমি এখন যাই–এই কাগজগুলো এখনই নিয়ে যেতে হবে।
প্রিয়াংকা হাতের কাগজের বান্ডিল নিয়ে ছুটে যেতে শুরু করল। ভলান্টিয়ারদের জন্যে আলাদা ভাবে তৈরি করা নীল রংয়ের একটা টি শার্ট পরেছে, বুকের মাঝে নাম লেখা ব্যাজ, খুব মানিয়েছে তাকে! দেখে মনে হচ্ছে তার জন্মই হয়েছে ভলান্টিয়ার হওয়ার জন্যে!
আমি মন খারাপ করে প্যান্ডেলের নিচে এসে দাঁড়ালাম। সবাই একজনের সাথে আরেকজন কথা বলছে, কার কয়টা হয়েছে বোঝার চেষ্টা করেছে। যখনই একটার উত্তর মিলে যাচ্ছে তখনই তাদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, যখন মিলছে
তখন মুখটা কালো করে ফেলেছে! আমিই শুধু একা একা দাড়িয়ে রইলাম। জয়ন্ত মামুন আর মৌটুসিকে দেখলাম কথা বলতে বলতে আসছে, আমাকে দেখে দাড়িয়ে গেলো। মামুন ভদ্রতা করে জিজ্ঞেস করল, কেমন হয়েছে?
আমি ইতস্তত করে বললাম, হয়েছে একরকম।
কয়টা হয়েছে?
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, একটা।
আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, তারা হাসি গোপন করল। জয়ন্ত ভদ্রতা করে বলল, ও, আচ্ছা।
আমি জযন্তকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার কয়টা হয়েছে?
পাঁচটা কনফার্ম। ছয় নম্বরটা কারো কারো সাথে মিলছে কারো কারো সাথে মিলছে না।
ও।
জয়ন্ত, মামুন আর মৌটুসি তখন জুস খেতে খেতে চলে গেলো। আমার খেয়াল হলো আমার হাতেও একটা জুস, যারা আজকে কম্পিটিশনে অংশ নিয়েছে সবাইকে এক প্যাকেট করে জুস দিয়েছে। আমি মনমরা হয়ে আমার জুসের প্যাকেটটা খুলে জুস খেতে লাগলাম।
দুপুরে এক ঘণ্টা বিরতি, তারপরে ব্ল্যাকহোলের ওপর একটা বক্তৃতা তারপর পুরস্কার বিতরণী। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আমার থাকার কোন ইচ্ছে নেই, কিন্তু ব্ল্যাক হোল নিয়ে কী বলে একটু শোনার ইচ্ছে আছে। তাই বক্তৃতাটা শোনার জন্যে থেকে গেলাম। সকালে রাগী চেহারার একজন বুড়োমতো মানুষ ব্ল্যাক হোল নিয়ে বিশাল একটা বক্তৃতা দিলো। মানুষটার উৎসাহ খুব বেশি এমন ভাবে কথা বলতে লাগলো যেন সে নিজেই টিপে টুপে ব্ল্যাক হোল তৈরি করেছে। বক্তৃতা দিতে দিতে মাঝে মাঝে সে রসিকতা করার চেষ্টা করলো, কিন্তু সেগুলো খুব কাজে এলো না। এক দুইজন ভদ্রতা করে একটু হাসার চেষ্টা করলো কিন্তু বেশির ভাগই মুখ শক্ত করে বসে থাকলো।
ব্ল্যাক হোলের উপর বক্তৃতাটা যত ভাল হবে ভেবেছিলাম সেটা তত ভাল হলো না। আমি মাঝখানেই উঠে যেতাম কিন্তু বসেছি একেবারে মাঝখানে, বের হওয়া খুব কঠিন।
বক্তৃতাটা শেষ হবার সাথে সাথে আমি বের হয়ে দেখি চারপাশে মিলিটারি, বের হওয়ার গেটটাও বন্ধ করে দিয়েছে, কাউকে বের হতে দিচ্ছে না। আমি একজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম পুরস্কার দেওয়ার জন্যে প্রেসিডেন্ট আসছেন বলে এরকম কড়াকড়ি। যারা ভিতরে আছে তারা এখন আর বের হতে পারবে না।
আমি আর উপায় না দখে পিছনের দিকে একটা চেয়ারে বসলাম। আস্তে আস্তে পুরো প্যান্ডেলটা ভরে গেলো। এদিকে সেদিকে মিলিটারি তাদের অস্ত্র হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। স্টেজটা সুন্দর করে সাজিয়েছে, সেখানে মেডেলগুলো এনে রেখেছে। সকালবেলা যে মেয়েটা অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিল সেই মেয়েটাকে আবার দেখলাম ব্যস্ত হয়ে হাঁটাহাঁটি করছে। আমি বসে প্রিয়াংকাকে খুঁজলাম কিন্তু এত ভিড়ে তাকে আমি খুঁজে পেলাম না।
হঠাৎ করে চারিদিকে একটু ব্যস্ততা দেখা গেলো সবাই হঠাৎ চুপচাপ হয়ে যায়। তখন আমি দেখতে পেলাম কয়েকজন মিলিটারি প্রায় ঘেরাও করে প্রেসিডেন্টকে নিয়ে আসছে। একটা দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়া নিশ্চয়ই খুব কষ্টের ব্যাপার—শান্তিমতো কোথাও যেতেও পারে না, সব সময় তাদের আগেপিছে গোটা দশেক মিলিটারি ঘুরঘুর করতে থাকে!
প্রেসিডেন্ট আসার সাথে সাথে তাকে নিয়ে বেশ কয়েকজন স্টেজে উঠে গেলো। সকালে বক্তৃতা দিতে পারে নি বলে যারা মন খারাপ করেছিল এখন তাদের খুব উৎফুল্ল দেখা গেলো, মনে হয় এখন তারা সবাই লম্বা লম্বা বক্তৃতা দেবে। প্রেসিডেন্টদের সময় নিয়ে খুব টানাটানি থাকে তাই ঝটপট অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেলো। হাসি-খুশি মেয়েটা আবার অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে থাকেসকালে সে অনেক হাসি-তামাশা করেছে এখন প্রেসিডেন্টের সামনে দরকারি কথা ছাড়া আর কোন কথা বলছে না। প্রথমে একজন এসে প্রেসিডেন্টের গুণগান গাইতে লাগলো, একজন প্রেসিডেন্ট এতো ব্যস্ত তারপরেও কষ্ট করে এখানে এসেছেন সেই জন্যে তাকে ধন্যবাদ দিতে দিতে সে মুখে প্রায় ফেনা তুলে ফেলল। তারপর আরেকজন দাড়িয়ে গণিত যে কতো গুরুত্বপূর্ণ সেটার ওপর বিশাল বক্তৃতা দিতে শুরু করল। আরেকজন দাড়িয়ে যারা আয়োজন করেছে তারা যে কতো মহৎ কাজ করেছে সেটার ওপর বিশাল একটা বক্তৃতা দিয়ে ফেললো। বক্তৃতাগুলো একই রকম, একই গলায় একই সুরে বলা হয়। একটা শুনলেই মনে হয় সবগুলো শোনা হয়ে গেছে। আমি প্রায় অধৈর্য হয়ে গেলাম।