আম্মু কেমন যেন হিংস্র গলায় বললেন, আদর করব? আমি? তোকে? কেন তোকে আদর করব? তুই কে? নিজের বাপকে খুন করে তুই এখন আমার কাছে এসেছিস?
আমার মনে হতে লাগলো সমস্ত দুনিয়াটা আমার চোখের সামনে ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছে, তবু আমি শেষবার চেষ্টা করলাম, বললাম, আম্মু! আমি তো কিছু করি নাই! আবু তো একসিডেন্টে মারা গেছেন।
তুই কেন একসিডেন্টে মারা গেলি না?
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, তুমি চাও আমিও একসিডেন্টে মারা যাই?
আম্মু চাপা গলায় বললেন, হ্যাঁ। আমি চাই। তুই আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যা। আর কোন দিন তুই আমার সামনে আসবি না!
কোন দিন আসব না? না।
বারান্দা থেকে আসা আবছা আলোতে আমি কিছুক্ষণ আম্মুর দিকে তাকিয়ে রইলাম, হঠাৎ করে আমার মনে হলো আমার বয়স বুঝি অনেক বেড়ে গেছে। মনে হলো আমি আর ছোট বাচ্চা নই, মনে হলো আমি অনেক বড় একজন মানুষ। আমি বুঝতে পারলাম এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই, আমি একেবারে একা। আমি যদি বেঁচে থাকতে চাই আমার একা বেঁচে থাকতে হবে, যদি বড় হতে চাই তাহলে একা বড় হতে হবে। আমার চোখের পানি হঠাৎ করে শুকিয়ে গেল, আমি বুঝতে পারলাম যার চোখের পানির কোন মূল্য নেই এই পৃথিবীতে তার থেকে হতভাগা আর কেউ নেই। আমি আর একটি কথা না বলে নিজের ঘরে ফিরে এলাম।
আমি সারারাত জানালার রড ধরে বসে ছিলাম। আব্রু মারা যাবার পর আমার বুকটা একেবারে ভেঙ্গে গিয়েছিল, কিন্তু এখন আমার বুকের ভেতর যে কষ্ট জমা হয়েছে সেটা কখনো কাউকে বলে বুঝাতে পারব না। নিজের ভেতর গভীর একটা অভিমান হলো, আম্মুর ওপর অভিমান, পৃথিবীর ওপর অভিমান, এমনকী আমাদেরকে ছেড়ে এতো তাড়াতাড়ি মরে যাবার জন্যে আব্বুর ওপর অভিমান। আমি রাতের বেলা জানালার রড ধরে বসে থাকতে থাকতে ঠিক করলাম আমি আত্মহত্যা করব।
আমি অবশ্যি আত্মহত্যা করতে পারি নি। আত্মহত্যা করার জন্যে মনে হয় অনেক সাহসের দরকার, দশ বছরের ছোট একটা ছেলের আসলে এত সাহস থাকে না। আমি আত্মহত্যা করার জন্যে অনেক দিন ওভার ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে থাকতাম, একটা বাস বা ট্রাক যাবার সময় আমি মনে মনে ঠিক করতাম যে এখন আমি লাফিয়ে পড়ব কিন্তু কখনোই শেষ পর্যন্ত লাফিয়ে পড়তে পারি নি। আত্মহত্যা না করলেও আত্মহত্যা করে যখন ইচ্ছা তখন সবকিছু শেষ করে দিতে পারব–এই চিন্তাটা আমার ভেতরে খানিকটা ভরসা এনে দিল আর এই ভরসাটার কারণেই আমি একদিন একদিন করে বেঁচে থাকতে লাগলাম।
আস্তে আস্তে বাসায় আমার অবস্থাটা আরো খারাপ হয়ে গেলো। আম্মু এমনিতে ভাল মানুষ, আব্বুর অফিসে তাকে বেশ ভাল একটা চাকরি দিয়েছে। অফিসের গাড়ি এসে আম্মুকে নিয়ে যায় আবার বিকেলে আম্মুকে বাসায় ফিরিয়ে দিয়ে যায়। আম্মু সারাদিন স্বাভাবিকভাবে অফিস করেন, কেউ কিছু বুঝতে পারে না। বাসাতে এসেও হাসিখুশি থাকেন কিন্তু আমাকে দেখলেই হঠাৎ করে খেপে যান, কেউ তাকে থামাতে পারে না। কোন উপায় না দেখে আপু আর ভাইয়া মিলে আমাকে আম্মুর চোখের সামনে থেকে আড়াল করে রাখতে শুরু করল। খাবার টেবিলেও আমি যাই না। আম্মু আপু আর ভাইয়াকে নিয়ে খানআমি খাই আলাদা। আগে নিয়ম ছিল সন্ধে হবার আগে সবাইকে বাসায় ফিরে আসতে হবে এখন সেই নিয়মটা শুধু আপু আর ভাইয়ার জন্যে, আমি বাসায় এসেছি কী আসি নি কেউ সেটা জানতে চায় না। একদিন আম্মুর নতুন অফিস থেকে একজন আমাদের বাসায় বেড়াতে এলো, আম্মু তাকে বললেন তার দুইজন ছেলে-মেয়ে; তারপর ভাইয়া আর আপুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
কেউ কেউ মনে করতে পারে আমি যে আছি সেটা আম্মু ভুলে গেছেন। কিন্তু সেটা সত্যি নয়, আম্মু আসলে সেটা একবারও ভুলতে পারেন না। যখন আস্তে আস্তে নিয়ম হয়ে গেলো আম্মু আপু আর ভাইয়াকে নিয়ে খাবে আর আমি খাব আলাদা তখন আমার খাবারটাও অন্যরকম হয়ে গেল। আম্মু খাওয়া শেষ করে দুলি খালাকে দিয়ে সব খাবার ফ্রিজে তুলে রাখতেন যেন আমি সেটা খেতে
পারি। দুলি খালা আমার জন্যে সেখান, থকে খাবার গরম করতে চাইলে আম্মু রেগে আগুন হয়ে যেতেন–দুলি খালা এতোদিন থেকে আমাদের বাসায় আছেন, তাকে পর্যন্ত আম্মু একেবারে অকথ্য ভাষায় গালাগাল শুরু করতেন।
আস্তে আস্তে আমি দুলি খালার সাথে রান্নাঘরে বসে খেতে শুরু করলাম। মোটা চালের ভাত, কোন একটা ভর্তা, বাসি ডাল এই ধরনের খাবার। দুলি খালা কখনো লুকিয়ে একটা ডিম ভাজা করে দিতো, রান্না করার সময় হয়তো আমার জন্যে একটু খাবার লুকিয়ে রাখতো–কখনো সেগুলো দিতো। আমি যখন খেতাম তখন দুলি খালা অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়তো আর দীর্ঘশ্বাস ফেলতো। আমি যে সত্যি সত্যি আত্মহত্যা করে ফেলি নি দুলি খালা তার একটা কারণ। আপু আর ভাইয়া আমার জন্যে যেটা করতে পারে নি দুলি খালা সেটা করেছিল, সে আমাকে বেঁচে থাকার জন্যে সাহস দিয়েছিল। আমি যখন খেতাম তখন আমার পাশে বসে ফিসফিস করে বলতো, শোন বাবা তপু। তোমার ওপরে কিন্তু খুব বড় বিপদ। তোমার মা তোমারে আদর করে না সেইটা সত্যি না। সন্তান হইল মায়ের শরীলের অংশ। সন্তান চোর ডাকাইত বদমাইশ যাই হোক মা তারে ভালবাসে। যদি কখনো কুনো মা তার সন্তানরে ভাল না বাসে তাহইলে তার অর্থ কী জানো?
আমি জিজ্ঞেস করতাম, কী?
দুলি খালা গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলতো, তার অর্থ তার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। তোমার মা অসুস্থ। তোমার মা পাগলি। তোমার বাপ মরে যাবার পর তার মাথাটা পুরাপুরি আউলে গেছে। অন্য কেউ বুঝতে পারে না, আমি পারি। চোখ দেখলেই বুঝতে পারি।