সাড়ে নয়টার সময় শুরু হবার কথা, আমি লিখে দিতে পারি সাড়ে দশটার এক মিনিট আগেও শুরু করতে পারবে না। আমার হাতে ঘড়ি নেই, আমি পাশের ছেলেটার হাতে দেখলাম সাড়ে নয়টা বেজে গেছে। শুরু না হওয়া পর্যন্ত চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই, তাই আমি মাত্র চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছি তখন অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেলো। বুড়ো এবং রাগী রাগী চেহারার কয়েকজন মানুষ স্টেজে এসে বসেছে, আমি গুনে দেখলাম নয়জন। এই নয়জনের সবাই বক্তৃতা দিবে, কমপক্ষে দশ মিনিট করে। নয় দশে নব্বই মিনিট, তার মানে পাকা দেড় ঘণ্টা! মানুষের বক্তৃতার মতো খারাপ জিনিস আর কিছু নেই, এখন পাকা দেড় ঘন্টা এই রাগী রাগী চেহারার মানুষগুলোর বক্তৃতা শুনতে হবে ভেবে মনটাই খারাপ হয়ে গেলো।
অনুষ্ঠান পরিচালনা করছে হালকা-পাতলা একটা মেয়ে। মেয়েটা খুব হাসিখুশি, সবসময়েই হাসছে। মাইকের সামনে দাড়িয়ে এমনভাবে কথা বলছে যে দেখে মনে হয় সুন্দর করে কথা বলার মতো সহজ কাজ আর কিছুই নয়! প্রিয়াংকা যখন বড় হবে, তখন নিশ্চয়ই এভাবে কথা বলবে। মেয়েটা গণিত প্রতিযোগিতার নিয়মকানুনগুলো বলে দিয়ে রাগী চেহারার একজনকে ডাকলো প্রতিযোগিতার উদ্বোধনী ঘোষণা করতে। রাগী চেহারার মানুষটি কোন একটা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর, সে এসে দুই এক কথা বলে প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করে দিল! কী আশ্চর্য ব্যাপার আর কোন বক্তৃতা নাই। স্টেজে বসে থাকা। আরো আটজন রাগী রাগী চেহারার বুড়ো মানুষগুলো নিশ্চয়ই খুব রাগ হয়েছে। যে তাদের বক্তৃতা দিতে ডাকছে না কিন্তু ততক্ষণে সব ছেলেমেয়েরা দৌড়াদৌড়ি করে কম্পিটিশনে অঙ্ক করার জন্যে তাদের ঘরের দিকে ছুটতে শুরু করেছে। এখন তারা বক্তৃতা দিলেও কেউ শুনবে না। হালকা-পাতলা মেয়েটা যে কাউকে বক্তৃতা দিতে দেয় নাই সে জন্যে আমার ইচ্ছে হলো তাকে এক স্টিক চুইংগাম দিয়ে আসি!
আমরা সবাই ক্লাস রুমে বসে আছি, আমার ডানদিকে অসম্ভব মোটা একটা ছেলে, বাম দিকে চশমা পরা শ্যামলা রংয়ের একটা মেয়ে। আমাদের স্কুলের অন্য ছেলে-মেয়েরা কোথায় বসেছে আমি জানি না, আশেপাশে কাউকে দেখছি না। আমাদের রুমটা বেশ বড়–সব মিলিয়ে প্রায় একশ জন ছেলে-মেয়ে এসে বসেছে। অঙ্ক কম্পিটিশনটা কীরকম হবে সে বিষয়ে আমার কোন ধারণা নেই, তাই ধৈর্য ধরে বসে আছি।
এরকম সময় ঘন্টা পড়ল এবং সাথে সাতে ক্লাস রুমের শিক্ষকেরা সবার হাতে একটা করে খাতা আর প্রশ্ন দিতে লাগলো। আমার ডান পাশের মোটা ছেলেটা চোখ বন্ধ করে একটা দোয়া পড়ে নিজের বুকে ফু দিল, তারপর প্রশ্নটা এবং হাতের কলমটাকে একটা চুমু খেয়ে মাথায় লাগালো। বাম পাশের মেয়েটা। অবশ্যি দোয়া দরুদের মাঝে গেল না, সরাসরি অঙ্ক কষার মাঝে লেগে গেলো। আমিও আমার প্রশ্নটার দিকে তাকালাম। দুই ঘণ্টা সময়, তার মাঝে দশটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। প্রশ্নগুলো বাংলা আর ইংরেজিতে, ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলে-মেয়েরাও যেন আসতে পারে সেজন্যে এই ব্যবস্থা।
আমি প্রশ্নগুলোর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। প্রশ্নগুলো একবারেই সোজা–একবার সন্দেহ হলো ভুল করে অন্য কোন ক্লাসের প্রশ্ন দিয়ে দিয়েছে কী না কে জানে! ভাল করে দেখলাম, আমাকে ঠিক প্রশ্নই দিয়েছে। এতো হৈচৈ করে গণিত প্রতিযোগিতা করছে কিন্তু এরকম সোজা বাচ্চা পোলাপানের প্রশ্ন। দিলো ব্যাপারটা কী? আমি ডানে-বামে সামনে-পিছনে তাকালাম, নাহ, অন্য। সবাই তো দেখি পেন্সিল কামড়ে কামড়ে গম্ভীর মুখে অঙ্ক করতে শুরু করেছে, মনে হয় প্রথম দিকে সোজা প্রশ্নগুলো দিয়ে শেষের দিকে কঠিন প্রশ্ন দিয়েছে। আমি শেষের প্রশ্নগুলো দেখলাম–আসলেই কঠিন! শুধু কঠিন না একেবারে ফাটাফাটি কঠিন। আমি কঠিন প্রশ্নটা পড়ে একটু হকচকিয়ে গেলাম। প্রশ্নটা কঠিন হতে পারে কিন্তু খুব চমৎকার একটা প্রশ্ন। শুধু প্রশ্নটা পড়েই আমার বুকটা ভরে গেলো, যারা এইরকম চমৎকার একটা প্রশ্ন করতে পারে তাদের মাথায় না জানি কতো বুদ্ধি! আগে সোজা প্রশ্নগুলো শেষ করে কঠিন প্রশ্নটা ধরা উচিত কিন্তু আমার যে কী হলো আমি কঠিন প্রশ্নটার উত্তর বের করতে শুরু করলাম।
আসল প্রশ্নটার উত্তর বের করার আগে আমার অন্য দুই একটি জিনিস প্রমাণ করতে হলো, সেগুলো প্রমাণ করার জন্যে আরো কয়েকটা জিনিস প্রমাণ করতে হলো। সবগুলো প্রমাণ শেষ করে যখন আসল সমস্যাটা করতে শুরু করেছি তখন মাঝামাঝি এসে আটকে গেলাম। শেষ পর্যন্ত কী ভাবে করতে হবে যখন হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম তখন আমার যা আনন্দ হলো সেটা বলার মতো নয়! ঝটপট পুরোটা শেষ করে, আমি অন্য সমস্যাগুলো করতে বসলাম। মাত্র প্রথমটা শুরু করেছি তখন দেখি কে যেন আমার খাতাটা ধরে টানছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি হলের গার্ড, ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে?
সময় শেষ।
সময় শেষ মানে? আমি চমকে উঠলাম, প্রশ্নের উপর স্পষ্ট লেখা আছে। সময় দুই ঘণ্টা। আমি বললাম, দুই ঘণ্টা সময় না?
হ্যাঁ। দুই ঘণ্টা শেষ।
দুই ঘণ্টা শেষ? আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম, দুই ঘণ্টা কী ভাবে শেষ হলো?
গার্ড মুচকি হেসে বলল, যখন সময় খুব ভাল কাটে তখন কীভাবে যে সময় চলে যায় কেউ জানে না! তারপর হা হা করে হেসে উঠল, যেন খুব একটা উঁচু দরের রসিকতা করেছে।
আমার খাতাটা টেনে নিয়ে চলে যেতে যেতে মানুষটা ফিরে এলো, বলল, কী ব্যাপার খাতায় দেখি নাম, রেজিস্ট্রেশন নম্বর কিছুই লিখ নি?