আমার হৃৎপিণ্ড হঠাৎ করে যেন থেমে গেলো। বিছানায় লাফ দিয়ে ভাইয়া উঠে বসেছে, ভয় পাওয়া গলায় চিল্কার করে উঠেছে, কে?
আমি কী করব বুঝতে পারলাম না। উপায় না দেখে ফিসফিস করে কাতর গলায় বললাম, ভাইয়া, আমি তপু।
ভাইয়া অবাক হয়ে বলল, তপু!
ততক্ষণে সর্বনাশ যেটা হবার সেটা হয়ে গেছে, পাশের ঘর থেকে আম্মু জিজ্ঞেস করেছেন, রাজীব, কী হয়েছে?
ভাইয়া বলল, কিছু না আম্মু।
কার সাথে কথা বলিস?
ভাইয়া ইতস্তত করে বলল, তপুর সাথে।
পাশের ঘরে আম্মু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন, তারপর আমি শুনতে পেলাম বিছানা থেকে নামছেন। আলো জ্বালালেন তারপর দরজা খুলে ভাইয়ার ঘরে এসে ঢুকলেন। ভাইয়ার ঘরে ঢুকে সুইচ টিপে আলো জ্বালালেন। তীব্র আলোয় আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। স্টোররুমে হঠাৎ করে আলো জ্বালালে তেলাপোকাগুলো যেমন কোথায় গিয়ে পালাবে বুঝতে পারে না, আমার অবস্থা হলো ঠিক সেরকম। আম্মুর সামনে আমি জবুথবু হয়ে দাড়িয়ে রইলাম, নিজেকে নিয়ে কোথায় লুকাবো আমি বুঝতে পারছিলাম না। এক পলকের জন্যে আম্মুর দিকে তাকিয়ে আমি মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলাম, আম্মুর চোখ ধ্বকধ্বক করে জ্বলছে।
আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, তুই এখানে কী করছিস?
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। কিছু না বলে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকাই মনে হয় সবচেয়ে নিরাপদ।
আম্মু আরও এক পা এগিয়ে এসে ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেন এসেছিস এখানে? আম্মু নিচের দিকে তাকালেন, আমার হাতে লেগে টেবিলে রাখা গ্লাসটা পড়ে ভেঙ্গে গেছে। শুধু যে গ্লাসটা ভেঙ্গেছে তা নয়, পানি পড়ে টেবিলে রাখা ভাইয়ার বই-কাগজপত্রও একটু ভিজে গেছে।
আম্মু আরও এক পা এগিয়ে এসে খপ করে আমার চুল ধরে একটা হ্যাচকা টান দিলেন, হিংস্র গলায় বললেন, কী করতে এসেছিস এই ঘরে?
আমি যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বললাম, একটা কলম নিতে এসেছিলাম।
আম্মু আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললেন, কলম নিতে এসেছিস? কলম?
আমি মাথা নাড়লাম। আম্মু গলায় বিষ ঢেলে বললেন, আমার জ্ঞানের সাগর আইনস্টাইন রাত দুপুরে এসেছেন কলম চুরি করতে! আমার সাথে তুই ইয়ারকি মারতে এসেছিস? তুই ভাবছিস আমি জানি না তোর পড়াশোনার নমুনা? তুই কয় সাবজেক্টে পাস করিস আর কয় সাবজেক্টে ফেল করিস আমি সেটা জানি না ভেবেছিস?
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আম্মু এদিক সেদিক তাকিয়ে চেয়ারে রাখা ভাইয়ার প্যান্ট থেকে তার বেল্টটা খুলে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। চিৎকার করে বললেন, সত্যি করে বল কেন এসেছিস? কী চুরি করতে এসেছিস?
কথা শেষ করার আগেই বেল্টটা দিয়ে আম্মু সমস্ত শরীরের শক্তি দিয়ে আমাকে মারলেন, মনে হলো আমার চামড়া কেটে বেল্টটা শরীরের ভেতর ঢুকে গেলো। যন্ত্রনায় আমি নিজের অজান্তেই কেঁদে উঠলাম।
আমাকে কাঁদতে দেখে আম্মু মনে হয় আরো খেপে উঠলেন, বেল্টটা দিয়ে আমাকে নির্মমভাবে আরো কয়েকবার মেরে বললেন, বল তুই কী করতে এসেছিস? বল জানোয়ারের বাচ্চা জানোয়ার।
আমার কান্না আর আম্মুর চিৎকার শুনে ভাইয়া তার বিছানা থেকে নেমে এসেছে, আপুও তার ঘর থেকে চলে এসেছে। দুলি খালাও বের হয়ে এসেছেন। সবাই নিঃশব্দে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, কেউ আমাকে বাঁচাতে এলো না। গরমের জন্যে আমার খালি গা, ময়লা খাটো একটা পায়জামা পরে আছি, ঠিকমতো গোসল করতে পারি না বলে গায়ে ময়লা, একমাথা ময়লা চুলে আমাকে নিশ্চয়ই দেখাচ্ছে হতচ্ছাড়া একজন মানুষের মতো। আমি জানি আমাকে দেখে কারো ভেতরে কোন মায়া হচ্ছে না, কোন করুণা হচ্ছে না। সবার ভিতরে এক ধরনের বিষ্ণা হচ্ছে, ঘেন্না হচ্ছে। একটা ঘেয়ো কুকুরকে যখন কেউ লাথি মারে, সেটা কেঁউ কেঁউ শব্দ করে পালিয়ে যায়, তখন সেই কুকুরটার জন্যে যেরকম মায়া হয় না, ঠিক সেরকম আমার জন্যেও কারো মায়া হচ্ছে না। আমার নিজেকে এতো ছোট, এতো জঘন্য মনে হতে লাগলো যে ইচ্ছে হলো মাটির তলায় ঢুকে যাই।
এক সময় আপু এগিয়ে এসে শুকনো গলা বলল, আম্মু তপু হয়তো আসলেই একটা কলমের জন্যে এসেছে। একটা কলম দিয়ে দাও। তারপর শুতে চলো। এতো চেঁচামেচি করলে তোমার শরীর খারাপ করবে।
আম্মু চিল্কার করে বললেন, তুই এই বদমাইশটার কথা বিশ্বাস করছিস? তুই জানিস এই বদমাইশটা একটা চোর? চুরি করতে এসেছে
আপু বলল, থাকুক আম্মু—
আম্মু বললেন, কেন থাকবে? একটা চোরকে আমি বাসায় পালব?
আপু কী বলবে বুঝতে পারল না, ঘুম ঘুম চোখে একটা হাই তুলে নিজের ঘরের দিকে রওনা দিল। আম্মু বললেন, আমি লিখে দিতে পারি এই বদমাইশটার ঘর সার্চ করলে বের হবে এটা কী কী জিনিস চুরি করে।
আপু আবার বলল, থাকুক আম্মু।
আম্মু বললেন, তুই আমার কথা বিশ্বাস করলি না? আয় আমার সাথে। তারপর আমার চুল ধরে হিড়হিড় করে আমাকে টেনে নিয়ে গেলেন আমার স্টোর রুমে। আমার ময়লা তোষকটা তার হাত দিয়ে ধরতে ঘেন্না হলো তাই পা দিয়ে সেটা ওল্টাতে শুরু করলেন। পালিয়ে যাবার জন্যে আমি অনেক দিন থেকে টাকা জমিয়ে যাচ্ছি–সত্যি কথা বলতে কী তার অনেকটুকু আমি আসলেই চুরি করেছি। কেউ যেন বুঝতে না পারে সেভাবে, অল্প অল্প করে। কখনো ভাইয়ার পকেট থেকে, কখনো আপুর ব্যাগ থেকে। বাসায় যখন কেউ নেই তখন ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে। এই সবগুলো টাকা আমি ঘরের কাগজে মুড়ে বিছানার নিচে লুকিয়ে রেখেছি, আম্মু পা দিয়ে সেটা বের করে ফেললেন। সাথে সাথে তার সারা মুখ আনন্দে চকচক করতে থাকে, ভাইয়া আর আপুকে ডেকে বললেন, দেখলি? দেখলি তোরা? আমি বলেছিলাম না এ চোর? দেখেছিস?