আমি তারপর ফিসফিস করে কবিতাটা আবৃত্তি করে শোনাতে থাকি। ডাইনিংরুমে তখন আম্মু আপু আর ভাইয়াকে নিয়ে খাচ্ছে। দুলি খালা টেবিলে খাবার নিয়ে যাচ্ছে, ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করছে। আমি সবকিছুকে ভুলে গিয়ে আমার নেংটি ইঁদুরকে ফিসফিস করে কবিতা শোনাতে লাগলাম। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাকে দেখলে খুব অবাক হতেন নিশ্চয়ই!
নেংটি ইঁদুরটাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে আমি আমার হাতের তালুতে তুলতে চেষ্টা করলাম কিন্তু সে রাজি হলো না। হাতের আঙুলগুলোর কাছাকাছি এসে সাবধানে গন্ধ শুকে এমন একটা ভাব করলো যে তার গন্ধটা পছন্দ হয় নি, তারপর লাফিয়ে লাফিয়ে চলে গেলো। এই নেংটি ইঁদুরের সময়ের জ্ঞান খুব বেশি, তার হাবভাব দেখেই মনে হচ্ছে কোথাও একটা জরুরি এপয়ন্টমেন্ট আছে, তাকে এখনই চলে যেতে হবে!
নেংটি ইঁদুরটা চলে যাবার পর আমি কিছু করার নেই বলে আমার বিছানায় শুয়ে পড়লাম। এখন মে মাস, ভ্যাপসা গরম। এই স্টোররুমের বিছানায় শুয়ে আমি এপাশ-ওপাশ করতে থাকি। আমার যখন ঘুম আসে না তখন আমি মাথার ভেতরে কোন একটা অঙ্ক করার চেষ্টা করি, তখন সময়টা বেশ কেটে যায়। ঘড়িতে ঠিক তখন সাড়ে দশটা বাজার একটা ঘণ্টা বাজলো তখন আমি চিন্তা করতে লাগলাম কতক্ষণ পর পর ঘড়ির ঘণ্টা আর মিনিটের কাটা ঠিক এক জায়গায় এসে হাজির হয়। ঘণ্টার কাঁটা প্রতি মিনিটে আধা ডিগ্রি যায় মিনিটের কাটা যায় ছয় ডিগ্রি। প্রথমবার ঘণ্টা আর মিনিটের কাঁটা এক জায়গায় থাকে ঠিক বারোটার সময়। এর পরের বার ঘণ্টা আর মিনিটের কাটা এক জায়গায় আসবে একটা বেজে সাড়ে পাঁচ মিনিটের দিকে। মিনিটের সঠিক সংখ্যাটা হচ্ছে ত্রিশকে সাড়ে পাঁচ দিয়ে ভাগ করলে যে সংখ্যা পাওয়া যায় সেটা। প্রতি ঘণ্টার পর এই সংখ্যার সমান সংখ্যক মিনিট সরে যেতে হবেসমস্যাটা আসলে একেবারে কঠিন না। একেবারে পানির মতো সোজা। সময় কাটানোর জন্যে আমার আরো কঠিন একটা সমস্যা দরকার।
একটা সমবাহু ত্রিভুজের প্রত্যেক বাহুর মাঝখানে যদি বাহুর তিন ভাগের এক ভাগ সমান একটা ত্রিভুজ বসানো হয় তাহলে কেমন হয়? সেই ত্রিভুজের মাঝখানে আরেকটা ছোট ত্রিভুজ, তার মাঝখানে আরেকটা এভাবে যদি বসানোই হতে থাকে তাহলে যে জিনিসটা তৈরি হবে তার পরিসীমা কতো? তার ক্ষেত্রফলইবা কতো? কিছুক্ষণের মাঝেই সমস্যাটা আমি মাথার মাঝে করে ফেললাম কিন্তু যে উত্তরটা পেলাম সেটা হলো খুব অদ্ভুত। ক্ষেত্রফল সসীম কিন্তু পরিসীমা অসীম। কী আশ্চর্য!
আমি বিছানা থেকে উঠে বসলাম, এটা একটা ভাল সমস্যা। এর পিছনে কিছুক্ষণ সময় কাটানো যায়। সমস্যাটা মাথার মাঝে করে ফেলা গেছে কিন্তু এটা সত্যি কীনা বোঝার জন্যে কাগজ-কলম লাগবে। আমি উঠে বসে আমার একটা খাতা আর কলম নিয়ে হিসেব করতে লাগলাম। ঠিক যখন মাঝামাঝি এসেছি আর দুটি লাইন করলেই পরিসীমাটি পেয়ে যাই তখন আমার বল পয়েন্ট কলমের কালিটা শেষ হয়ে গেল! আমার এতো মেজাজ খারাপ হলো যে বলার মতো নয়–ইচ্ছে হলো কলমটাকে কামড়ে খেয়ে ফেলি। কিন্তু বল পয়েন্ট কলম কামড়ে খেয়ে ফেললেও তো সেটা থেকে লেখা বের হবে না!
আমি আমার কাগজগুলো নিয়ে ছটফট করতে লাগলাম, সমস্যাটা শেষ করার জন্যে হাত নিশপিশ করতে লাগলো। ভাইয়া কিংবা আপুর কাছ থেকে একটা কলম চেয়ে আনা যায়, কিন্তু আম্মুর চোখে পড়ে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে! সবাই ঘুমিয়ে যাবার পর খুব সাবধানে উঠে গিয়ে ভাইয়া কিংবা আপুর টেবিল থেকে একটা কলম নিয়ে আসা ছাড়া আর কোন সহজ উপায় নেই। তা হলে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বাসা থেকে পালিয়ে যাবার জন্যে অনেকদিন থেকে আমি একটু একটু করে টাকা-পয়সা জমানোর চেষ্টা করছি, সেখান থেকে দুটো টাকা নিয়ে একটা বল পয়েন্ট কলম কিনে ফেলা যাবে। কিন্তু এখন রাত সাড়ে দশটা-এগারোটার সময় আমার কিছুই করার নেই।
সবকিছু ভুলে গিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করা যায় কিন্তু আমি ঘুমাতে পারছি না। দেখাই যাচ্ছে আমি যে জিনিসটার পরিসীমা আর ক্ষেত্রফল বের করার চেষ্টা করছি তার মাঝে একটা বিচিত্র ব্যাপার রয়েছে। এর ক্ষেত্রফল অসীম কিন্তু পরিসীমা সসীম। এটা কীভাবে হতে পারে?
বিষয়টা ভাল করে দেখার জন্যে আমার ভেতরটা আঁকুপাকু করতে লাগলো। আমার দরকার একটা কলম বা পেন্সিল! আমি আমার বিছানা কাগজপত্র ভাল করে উল্টেপাল্টে দেখলাম, কোথাও আরেকটা কলম কিংবা পেন্সিল নাই। বহুদিন থেকে লেখাপড়া করি না, তাই থাকার কথাও না। কী করব বুঝতে না পেরে শুয়ে শুয়ে আমি ছটফট করতে লাগলাম।
রাত সাড়ে এগারোটার দিকে বাসার সব আলো নিভে গেল, তার মানে সবাই শুয়ে পড়েছে। তারপর আমি আরো কিছুক্ষণ সময় দিলাম, যখন মনে হলো সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে তখন আমি সাবধানে আমার বিছানা থেকে উঠে পা টিপে টিপে ভাইয়ার ঘরের সামনে হাজির হলাম। খুব সাবধানে দরজাটা একটু খুলে ঘরের ভিতরে ঢুকে গেলাম। ঘরের ভেতর আবছা অন্ধকার, কোন কিছু দেখা যায় না। বাম পাশে বিছানায় ভাইয়া ঘুমাচ্ছে, পাশে টেবিলে তার বই খাতাপত্র। টেবিলের উপরে নিশ্চয়ই কলম পেন্সিল ছড়ানো থাকবে সেখান থেকে হাতড়ে একটা কলম খুঁজে নিতে হবে। আমি টেবিলের উপর হাত দিলাম, বই, কিছু কাগজ, গানের সিড়ি এরকম জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিন্তু কোন কলম বা পেন্সিল নেই। আমি দুই পাশে হাত বুলাতে থাকি, অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না হঠাৎ করে হাত লেগে কিছু একটা পড়ে গেলো, টেবিল থেকে গড়িয়ে সেটা মেঝেতে পড়ে সশব্দে ভেঙ্গে যায়।