এদিকে মা দৌড়াদৌড়ি করে রান্না বসিয়েছেন। ছেলের জন্যে গরম ভাত আর শিং মাছের ঝোল। ছেলের খুব প্রিয় খাবার শিং মাছ। রান্না যখন শেষের দিকে তখন হঠাৎ বাসার চারপাশে ধূপধাপ শব্দ, মানুষজন দৌড়াদৌড়ি করছে। ছেলেটি হাতের স্টেনগান হাতে নিয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, মা, আমাকে যেতে হবে।
মা ভয় পাওয়া গলায় বললেন, কেন বাবা কী হয়েছে?
ছেলে বলল, রাজাকাররা বাসা ঘিরে ফেলেছে। আমাকে যদি বাসার ভেতরে পায় তোমাদের খুব বড় বিপদ হবে মা। মা ফিসফিস করে খোদাকে ডেকে বললেন, ইয়া মাবুদ ইয়া পরওয়ার দিগার, আমার ছেলেকে তোমার। হাতে দিলাম, তুমি তাকে রক্ষা করো–
ছেলে মাকে কদমবুসি করে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে স্টেনগান হাতে রাতের অন্ধকারে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।
প্রথমে কোন শব্দ নেই, তারপর হঠাৎ কয়েকজন মানুষের চিঙ্কার শোনা গেলো তারপর গুলির শব্দ। রাইফেল আর স্টেনগানের গুলি তারপর কোন শব্দ নেই। মা আর বোন জানালার পর্দা তুলে বাইরে তাকাল, দেখলো রাস্তার মাঝখানে কে যেন পড়ে আছে।
কিছু বোঝার আগে ছোট বোনটি দরজা খুলে অন্ধকারে ছুটে গেলো, গিয়ে দেখলো রাস্তার মাঝখানে উপুড় হয়ে পড়ে আছে তার ভাই। বোনটি খুব ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে ভাইটির মাথাটি বুকে তুলে নিয়ে ফিসফিস করে ডাকল, ভাই।
ভাইটি তখন চোখ খুলে তাকালো। রাত্রের আবছা অন্ধকারে দুই ভাইবোন তখন একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে রইল। ভাইটি তখন ফিসফিস করে কিছু একটা বলল, বোনটি শুনতে পেলো না। তাই সে মাথাটা আরো নিচু করে নিলো, শুনলো ভাই ফিসফিস করে বলছে, তুই আমাকে সোনার বাংলা গানটা শুনাবি?
বোন তখন তার চোখ মুছে তার ভাইয়ের মাথাটা কোলে নিয়ে আস্তে আস্তে আমার সোনার বাংলা গানটি গাইতে লাগলো। আস্তে আস্তে চারিদিক থেকে রাজাকাররা তাকে ঘিরে ফেলছিল কিন্তু সে তবু গানটি বন্ধ করল না। বোনটি গাইতেই লাগলো–গাইতেই লাগলো!
প্রিন্সিপাল ম্যাডামের গলা ধরে এলো। তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, মেয়েটির যখন গানটি শেষ হয়েছে তখন তার ভাইটি আর বেঁচে নেই। রাজাকাররা তাদের দুজনকে ঘিরে রেখেছিল কিন্তু কাছে আসতে সাহস পাচ্ছিল না। বোনটি তার ভাইয়ের মাথাটা কোলে নিয়ে বসেই রইল। বসেই রইল।
আমাদের কেউ বলে দেয় নি কিন্তু আমরা সবাই জানি সেই বোনটি হচ্ছে আমাদের প্রিন্সিপাল ম্যাডাম। আমরা তার দিকে তাকিয়ে সেই ছোট মেয়েটিকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম।
০৫. চোর
বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়াটা আরও কয়েকদিনের জন্যে পিছিয়ে দিতে হলো। স্কুল থেকে আমাকে টি.সি দিয়ে বের করে দেয়া হবে না সেটা আমি বুঝে গেছি। সেদিন যখন স্কুল ছুটি হবার পর বাসায় ফিরে যাচ্ছি তখন প্রিয়াংকা আমার কাছে ছুটে এসে বলল, তপু।
আমি বললাম, কী?
তুই দেখলি কী হলো?
অনেক দিন পর কেউ একজন আমার সাথে তুই তুই করে কথা বলল। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম একজন যখন আরেকজনের সাথে আন্তরিকভাবে কথা বলে তখন কেমন লাগে। আমি আমার অবাক হওয়াটা গোপন রেখে বললাম, কেন কী হয়েছে?
তুই প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে কী বলেছিলি মনে আছে?
কী?
রাজাকার স্যার রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ান না, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে টিটকারি মারেন—
আমার মনে পড়ল, বললাম, ও, হ্যাঁ মনে আছে।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ঠিক এগুলি নিয়ে কথা বলেছেন। রাজাকার স্যার দশ বছর ধরে যে সর্বনাশ করার চেষ্টা করেছেন প্রিন্সিপাল ম্যাডাম এক ঘণ্টায় সেটা ঠিক করে দিলেন। প্রিয়াংকা আনন্দে দাঁত বের করে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
আমার দিকে তাকিয়ে অনেকদিন কেউ হাসে নি, আমার কাছে বিষয়টা এমন বিচিত্র মনে হলো যে আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে প্রিয়াংকার দিকে তাকিয়ে রইলাম। প্রিয়াংকা বললাম, তোর কী হলো? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?
আমি বলল, না কিছু হয় নাই।
প্রিয়াংকা বলল, প্রিন্সিপাল ম্যাডামের জন্যে কিছু একটা করতে হবে।
আমি বললাম, কী করবে? বলতে চেয়েছিলাম কী করবি? কিন্তু বলতে পারলাম না। কীভাবে কীভাবে জানি নিজের চারিদিকে একটা দেওয়াল তুলে ফেলেছি, কারো সাথে সহজ হতে পারি না।
প্রিয়াংকা বলল, এখনও ঠিক করি নাই। চিন্তা করছি।
প্রিয়াংকা মনে হয় চিন্তা করতে করতেই ব্যাগ ঝুলিয়ে চলে গেলো। আমিও স্কুল থেকে বের হয়ে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতে লাগলাম। অন্ধকার হবার আগে আমি কখনো বাসায় ফিরে যাই না।
সেদিন রাত্রিবেলা আমি একটা বিচিত্র কাজ করলাম। স্টোররুমে আমার বিছানায় গুটিশুটি মেরে বসে আমাদের বাংলা বইয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতাটা মুখস্থ করে ফেললাম। মোটামুটি বড় কবিতা কিন্তু দেখতে দেখতে মুখস্থ হয়ে গেলো। আমি যখন মনে মনে কবিতাটা আবৃত্তি করছি ঠিক তখন নেংটি ইঁদুরটা দরজার চৌকাঠের অন্যপাশ থেকে আমার দিকে উঁকি দিল। আমি মেঝেতে আঙুল দিয়ে ঠোকা দিয়ে ফিসফিস করে বললাম, এই মিচকি! এই!
নেংটি ইঁদুরটা আমার দিকে এগিয়ে এলো, আমি আমার পকেট থেকে ছোট ছোট রুটির টুকরো বের করে কাছাকাছি ছড়িয়ে দিলাম। নেংটি ইঁদুরটা একটু দূর থেকে সাবধানে আমাকে লক্ষ্য করে আস্তে আস্তে কাছে এসে একটা রুটির টুকরো সাবধানে সরিয়ে নিয়ে কুটুর কুটুর করে খেতে থাকে। আমি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, এই মিচকি? তোর কী কবিতা ভাল লাগে?।
নেংটি ইঁদুরটা আমার কথার উত্তর না দিয়ে তার দ্বিতীয় টুকরোটার জন্যে এগিয়ে এলো। আমি ফিসফিস করে বললাম, শুনবি কবিতাটা? নেংটি ইঁদুরটা তার মাথা তুলে সাবধানে আমার দিকে তাকালো, আমি সেটাকেই সম্মতির চিহ্ন হিসেবে ধরে নিয়ে বললাম, তাহলে শোন।