বিষয়টা চিন্তা করতে করতে আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম। হঠাৎ শুনলাম জহুরুল দাড়িয়ে বলছে, আমার বড় চাচা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এখন রিটায়ার করেছেন। তারপর ইশতিয়াক দাঁড়াল, সে বলল, আমাদের পাশের বাসায় একজন মুক্তিযোদ্ধা থাকেন। নাঈমা বলল, আমার আগের স্কুলের অঙ্ক স্যার মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম নিশ্চয়ই সবার কাছে জানতে চাইছেন ক্লাসের ছেলে মেয়েদের পরিচিত কেউ মুক্তিযোদ্ধা আছে কীনা। অনেকেই বলল, আমিও ভাবলাম আমিও বলি যে আমার আব্বু মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, কিন্তু আমি কিছু বললাম না। কেউ প্রশ্ন না করলে নিজে থেকে কিছু বলার বিষয়টি আমি ভুলেই গিয়েছি।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে যারা বেঁচে আছে এখন যদি তাদের দেখো দেখবে তাদের চুল পেকে গেছে। তাদের বয়স হয়ে গেছে। কিন্তু যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় মারা গেছে তাদের কারো বয়স হয়নি, তাদের বয়সটা সতেরো আঠারো উনিশ বছরে আটকে গেছে। তারা আর কোন দিন বুড়ো হবে না, তারা অনন্তকাল কিশোর থাকবে। তরুণ থাকবে। কী আশ্চর্যের একটা ব্যাপার, তাই না?
আমরা কেউই ব্যাপারটা এভাবে চিন্তা করি নাই। সত্যিই তো একজন মানুষ যখন কম বয়সে মারা যায় তখন তার তো আর বয়স বাড়ে না। সে তো সারাজীবনই কম বয়সী থেকে যায়! মানুষটি বেঁচে থাকে না কিন্তু তার স্মৃতিটা বেঁচে থাকে। কী সাধারণ একটা ব্যাপারকে ইচ্ছে করলেই কী অসাধারণ ভাবে দেখা যায়। আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ কেমন জানি অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন, মনে হতে লাগলো আমাদেরকে দেখেও দেখছেন না। মনে হতে লাগলো অনেক দূরে কোথাও তাকিয়ে আছেন। খানিকক্ষণ সেভাবে তাকিয়ে থেকে আমাদের দিকে ফিরে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বললেন, তোমাদেরকে একজন মুক্তিযোদ্ধার গল্প বলি। সত্যি গল্প।
একাত্তুর সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে তখন ছেলেটা পড়ে ক্লাস টেনে। স্কুলের ছাত্র, তোমাদের থেকে দুই এক বছর বেশি বয়স হবে। এত ছোট ছেলের তো যুদ্ধে যাবার কথা না কিন্তু তবু সে বাসা থেকে পালিয়ে চলে গেলো যুদ্ধে।
তার একটি ছোট বোন ছিলো, পিঠাপিঠি ভাই-বোন তাই দুজনে শুধু ঝগড়া করতো। সত্যিকারের ঝগড়া না, পিঠাপিঠি ভাইবোনের ঝগড়া। কে মশারি টানাবে সেটা নিয়ে ঝগড়া। বইয়ের মলাট কে ছিঁড়ে ফেলল সেটা নিয়ে ঝগড়া, গল্প বই কে আগে পড়বে সেটা নিয়ে ঝগড়া।
ভাইটি যে রাতে বাসা থেকে পালিয়ে যুদ্ধে চলে গেলো সেদিনও বোন তার সাথে ঝগড়া করেছিল, একেবারে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া। তার প্রিয় কলমের নিব ভোঁতা করে ফেলা নিয়ে ঝগড়া। বোনটা তো আর জানতো না যে তার ভাই সেই রাতে যুদ্ধে চলে যাবে, তাহলে নিশ্চয়ই সে রাতে আর ঝগড়া করতো না!
যাই হোক, ছোট ছেলে অনেক কষ্ট করে বর্ডার পার হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়েছে। এত ছোট ছেলে, কেউ তাকে যুদ্ধে নিতে চায় না, অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা দলে ঢুকে পড়ল। তাদের সাথে ট্রেনিং নিয়ে সে দেশের ভেতরে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছে।
আস্তে আস্তে দিন পার হতে থাকে। প্রথম দিকে মনে হচ্ছিল পাকিস্তান মিলিটারিদের বুঝি কেউ হারাতে পারবে না, কিন্তু যতই দিন যেতে শুরু করেছে ততই বোঝা যেতে শুরু করেছে এই দেশে তাদের দিন একেবারে হাতেগোনা। আগে যেখানে পাকিস্তান মিলিটারির ভয়ে কেউ ঘর থেকে বের হতো না, সেসব জায়গাতেও রাত্রি বেলা গেরিলা বাহিনী এসে আক্রমণ করে বসে।
এ রকম সময় সেই ছেলেটা তার দলের সাথে কাছাকাছি একটা এলাকায় এসেছে। কয়েকটা গেরিলা অপারেশান করে দলটি যখন ফিরে যাবে তখন ছেলেটা তার দলের কমান্ডারের কাছে বলল সে এক রাতের জন্যে তার বাসায় গিয়ে মা আর বোনের সাথে দেখা করতে চায়। কমান্ডার প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না, শেষে ছোট ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে তার মায়া হলো, তিনি অনুমতি দিলেন।
গভীর রাতে ছেলেটা তার বাসায় এসেছে। দরজায় টুকটুক শব্দ করছে, ঘুম ভেঙে মা অবাক হয়ে ভাবলেন, এতো রাতে অসময়ে কে এসেছে? দরজার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে ভয় পাওয়া গলায় বললেন, কে?
ছেলেটা ফিসফিস করে বলল, আমি, মা। মা দরজা খুলে ছেলেটাকে ঘরের ভেতর টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে সে কী কান্না। শুধু শরীরে হাত বুলান আর ফিসফিস করে বলেন, তোর শরীরে কোথাও গুলি লাগে নি? কোথাও গুলি লাগে নি?
ছেলেটা হাসে আর বলে, মা, গুলি লাগলে আমি তোমার কাছে এলাম কেমন করে?
এতো রাতে কথাবার্তা শুনে বোনটিও জেগে উঠেছে। ভাইকে দেখে কী অবাক। তার এইটুকুন ভাই, এখন তার আঁকড়া ঝাকড়া উষ্কখুষ্ক চুল, রোদে পোড়া চেহারা, পিঠে ছোট স্টেনগান, একেবারে সত্যিকারের যোদ্ধা! ভাই বোনকে জিজ্ঞেস করল, তুই কী এখনো আমার ওপর রাগ করে আছিস? দেশ স্বাধীন হোক তখন আমি তোকে এক ডজন কলম কিনে দেব!
তার কথা শুনে বোনটি ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল। ভাইটি তখন তার মাথায় হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে বলল, ধুর বোকা মেয়ে কাদিস না। দেখিস, দেখতে দেখতে দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে–পাকিস্তানিরা পালিয়ে যাবার জায়গা পাবে না। বোনটা তখন লাজুক মুখে বলল, ভাইয়া আমি আমার সোনার বাংলা গানটা তুলতে পারি–হারমোনিয়ামে তোমাকে বাজিয়ে শোনাব? ভাইটি বলল, এতো রাতে সেটা বাজালে আশেপাশে সন্দেহ করতে পারে–যখন দেশ স্বাধীন হবে তখন তুই বাজিয়ে শোনাবি। ঠিক আছে?