প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কিছুক্ষণ কিছু একটা ভাবলেন, ভেবে বললেন, আমার প্রিয় কবিতা তো একটা নয়, অনেকগুলো।
প্রিয়াংকা বলল, তার মাঝে যে কোন একটা আবৃত্তি করেন, প্লিজ।
আমার ধারণা ছিল ম্যাডাম হয়তো রাজি হবেন না, কিন্তু একটু অবাক হয়ে দেখলাম বেশ সহজেই রাজি হয়ে গেলেন, কেশে গলাটা একটু পরিষ্কার করে সরাসরি আবৃত্তি শুরু করে দিলেন,
আমরা দুজন একই গাঁয়ে থাকি,
সেই আমাদের একটি মাত্র সুখ।
তাদের গাছে গায় যে দোয়েল পাখী
তাহার গানে আমার নাচে বুক।
ম্যাডাম এতো সুন্দর করে কবিতাটা শোনাতে লাগলেন যে খঞ্জনা নামের সেই গ্রামের পুরো দৃশ্যটা আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমরা স্পষ্ট দেখতে পেলাম এই গ্রামটির ভেতর দিয়ে অঞ্জনা নামের নদীটি বয়ে যাচ্ছে আর সেই নদীর তীরে রঞ্জনা নামে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সত্যি কথা বলতে কী গান কবিতা এইসব জিনিসকে সব সময় আমার কাছে ন্যাকামি টাইপের জিনিস বলে মনে হতো–যারা এগুলো করে তাদেরকে মনে হতো হাস্যকর একধরনের মানুষ। কিন্তু প্রিন্সিপাল ম্যাডামের মুখে কবিতাটা শুনে আমার সমস্ত ধারণাটাই পাল্টে গেলো, আমার মনে হতে লাগলো কবিতার মতো সুন্দর জিনিস পৃথবীতে আর কিছু নেই। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম যে খুব সুন্দর করে আবৃত্তি করেন তা নয় কিন্তু কবিতার মাঝে এমনভাবে তার সমস্ত মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন যে কবিতাটা একেবারে অন্যরকম কিছু একটা হয়ে গেলো। কবিতাটা শেষ হবার পরও আমরা কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে বসে থাকলাম, আমাদের মনে হতে লাগল আমরা যদি কথা বলি তাহলে কিছু একটা নষ্ট হয়ে যাবে–সেই কিছু একটা যে কী আমরা কেউই সেটা ঠিক ধরতে পারছিলাম না।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, অনেক দিন পর আজকে একটা কবিতা বললাম।
শিউলি বলল, আপনি এতো সুন্দর করে কবিতা বলেন ম্যাডাম!
শিউলি আমাদের ক্লাশের সবচেয়ে চুপচাপ মেয়ে, সে যে এভাবে নিজে থেকে কিছু বলবে আমরা বুঝতেই পারি নি, কিন্তু কথাটাকে একটুও অস্বাভাবিক মনে হলো না। আমরা সবাই শিউলির কথার সাথে সাথে মাথা নাড়লাম। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, আসলে আমি সুন্দর করে কবিতা বলি নি, কবিতাটাই খুব সুন্দর।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম হালকা পায়ে হেঁটে হেঁটে জানালার কাছে গিয়ে একবার বাইরে তাকিয়ে আবার ক্লাসের মাঝামাঝি এসে বললেন, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারা পৃথিবীর সকল কবি সাহিত্যিক গীতিকার থেকে একটি বিষয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে আছেন, সেটা কী কে বলতে পারবে?
মামুন হাত তুলে বলল, সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন?
উঁহু। ম্যাডাম মাথা নাড়লেন, নোবেল প্রাইজ তো অনেকেই পেয়েছেন–সেটি নয়। অন্য কিছু আছে।
ক্লাসের সবাই মাথা চুলকাতে লাগলো তখন ম্যাডাম নিজেই বললেন, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একমাত্র মানুষ যার লেখা গান দুটি ভিন্ন ভিন্ন দেশের জাতীয় সঙ্গীত। একটি আমাদের বাংলাদেশের, আরেকটা ভারতবর্ষের।
আমি এটা জানতাম না, শুনে বেশ অবাক হয়ে গেলাম।
ম্যাডাম একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমাদের জাতীয় সঙ্গীত, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি এটা এতো মধুর একটা গান, কিন্তু যতবার এই গানটা আমি শুনি ততবার চোখে পানি এসে যায়।
মৌটুসি জিজ্ঞেস করল, কেন ম্যাডাম?
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, জানি না কেন, মনে হয় মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ছোট ছিলাম, প্রতিদিন এই গানটা শুনতাম আর ভাবতাম কবে আমাদের দেশটা স্বাধীন হবে, সেইজন্যে এই গানটার জন্যে আমাদের মতো মানুষের অন্য রকম একটা মায়া।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কিছুক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে থেকে বললেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দেশে কী হয়েছিল তোমরা জানো?
অনেকে বলল, জানি। কয়েকজন বলল, না জানি না। বাকিরা চুপ করে রইল। আমাদের পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধের যে কথাবার্তা লেখা আছে তার অনেকগুলো নাকী ভুয়া। প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে সেটা জিজ্ঞেস করলে ইতো কিন্তু আমি ক্লাসে কখনো কোন স্যার-ম্যাডামকে কিছু জিজ্ঞেস করি না। খারাপ ছেলে হিসেবে একবার পরিচয় হয়ে যাবার পর আর কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করা যায় না।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দেশে অনেক কিছু হয়েছিল, কিন্তু কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে কোন বিষয়টি সবচেয়ে বেশি হয়েছিল আমি কী বলব জানো?
ক্লাসের প্রায় সবাই জিজ্ঞেস করল, কী ম্যাডাম?
দুঃখ। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তখন এই দেশে এমন একটি পরিবার ছিল না যাদের কোন না কোন আপনজন মারা যায় নি। এই দেশের প্রত্যেকটা পরিবার, প্রত্যেকটা মানুষকে সেই মুক্তিযুদ্ধ স্পর্শ করেছিল।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম হেঁটে জানালার কাছে গিয়ে কয়েক মুহূর্ত জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন, তারপর ঘুরে ক্লাসের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি একজন মাকে জানি যার ছেলেকে পাকিস্তান মিলিটারিরা মেরে ফেলেছিল। সেই মা তারপর থেকে যতদিন বেঁচে ছিল কোন দিন ভাত খায় নি, মৃত্যুর আগে ছেলেটা ভাত খেতে চেয়েছিল, তার জন্যে রান্না করে তার মা ভাত পাঠিয়েছিলেন, সেই ছেলেটা সেই ভাত খেতে পারে নি, সেজন্যে।
ঠিক কী কারণ জানি না আমার তখন হঠাৎ আমার নিজের মায়ের কথা মনে পড়ল। এখন যদি মুক্তিযুদ্ধের সময় হতো আর আমি যদি মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে পাকিস্তান মিলিটারির হাতে ধরা পড়ে যেতাম আর পাকিস্তান মিলিটারি যদি আমাকে টর্চার করতো সেই খবরটা শুনে আম্মু কী করতেন? খুশি হতেন?