প্রিয়াংকা বলল, তুমি খুব ভাল অঙ্ক জানো তাই না?
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, উঁহু।
তোমার কী অঙ্ক ভাল লাগে?
আমি আমার সিটে হেলান দিয়ে বললাম, আমার কিছু ভাল লাগে না।
প্রিয়াংকা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের জায়গায় ফিরে গেলো।
থার্ড পিরিয়ডে বাংলা ক্লাসে রাজাকার স্যার আসবেন, আমি ভিতরে ভিতরে একটা কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করছি, স্যার ক্লাসে এসে আজকে কী করেন দেখতে চাই। আজকেও জয়ন্ত দীলিপ আর সলীলকে পেটান কী না, নীলিমা আর মাধুরীকে খামোখা যাচ্ছেতাই ভাষায় গালাগাল করেন কী না দেখার জন্যে খুব কৌতূহল হচ্ছে।
কিন্তু আজ একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটলো, ক্লাসে রাজাকার স্যারের বদলে এলেন প্রিন্সিপাল ম্যাডাম। আমরা সবাই তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালাম। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম হাত দিয়ে আমাদের বসার জন্যে ইঙ্গিত করে বললেন বসো। বসো।
আমরা নিজেদের জায়গায় বসেছি। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম পুরো ক্লাসে একবার চোখ বুলিয়ে বললেন, আমি অনেক দিন থেকে ভাবছি নিয়মিত কোন একটা ক্লাস নিই, কিন্তু এমন ঝামেলার মাঝে থাকি ক্লাস নেবো কেমন করে অফিস থেকেই বের হতে পারি না! | প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কথা শেষ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন আর সাথে সাথে আমরা সবাই আবার বুঝতে পারলাম, প্রিন্সিপাল ম্যাডামের চেহারা খুব সুন্দর, তিনি শুধু সেটা কাউকে জানতে দিতে চান না। প্রিন্সিপাল ম্যাডামের হাসিটি পুরো ক্লাসের মাঝে ছড়িয়ে পড়ল এবং আমরা সবাই কোন কারণ ছাড়াই হাসলাম।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ক্লাসের সামনে দাড়িয়ে আমাদের একটু খোজখবর নিলেন, কার নাম কী, বাসা কোথায়–এসব ব্যাপার নিয়েও দুই-চারজনের সাথে কথা বললেন। পড়াশােনা কেমন হচ্ছে জানতে চাইলেন, তারপর হালকা পায়ে একটু হেঁটে ক্লাসরুমের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে বললেন, এটা তোমাদের বাংলা ক্লাস, তাই বাংলা নিয়ে একটু কথাবার্তা বলা দরকার, কী বলো?
আমরা সবাই মাথা নাড়লাম। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে বললেন, আচ্ছা বল দেখি বাংলা ভাষাটাকে একটা নতুন মাত্রা দেয়ার জন্যে যদি শুধুমাত্র একজন মানুষের নাম বলতে হয় সেই মানুষটা কে হবে?
ক্লাসের অনেকে উত্তর বলার জন্যে হাত তুললো এবং যাদের উৎসাহ বেশি তারা চিৎকার করে বলল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম মাথা নাড়লেন, বললেন, ভেরি গুড়। তারপর আর দুই পা এগিয়ে এসে বললেন, এই বুড়ো মানুষটি বাংলা ভাষাকে যতটুকু সমৃদ্ধ করেছেন পৃথিবীর আর কোন মানুষ একা তাদের ভাষাকে ততটুকু সমৃদ্ধ করতে পারে নি।
সত্যি কথা বলতে কী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন না অনেকে মিলে করেছেন সেটা নিয়ে ক্লাসের ছেলেমেয়েদের খুব একটা মাথাব্যথা আছে বলে মনে হলো না। তবে ম্যাডাম এতো সুন্দর করে কথা বলেন যে সবাই ভাব করতে লাগল ব্যাপারটা খুব গুরুত্ত্বপূর্ণ।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আরেকটু এগিয়ে এসে বললেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন সেটা কীভাবে বোঝা যায় বলো দেখি?
এবারে সবাই মুখ গম্ভীর করে চিন্তা করতে লাগল কী বলা যায়। কেউ কিছু বলার আগেই ম্যাডাম নিজে থেকে বললেন, সেটা বোঝার জন্যে রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য নিয়েও গবেষণা করতে হয় –তার যে কোন একটা কবিতা পড়লেই সেটা বুঝে ফেলা যায়।
কথা শেষ করে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম এমনভাবে আমাদের দিকে তাকালেন যে আমরা সবাই তার কথা বিশ্বাস করে ফেললাম। ম্যাডাম এবার একেবারে সামনের বেঞ্চে হাত রেখে আস্তে আস্তে বললেন, তোমরা নিশ্চয়ই কখনো না কখনো রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়েছ। আমি বাজি ধরে বলতে পারি তোমাদের অনেকের রবীন্দ্রনাথের কবিতা মুখস্থ আছে। কে আমাদের একটা কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতে পারবে?
আমি যখন ছোট ছিলাম তখন রবীন্দ্রনাথের বীরপুরুষ কবিতাটি আবৃত্তি করতাম, অনেক দিন সেটা প্র্যাকটিস করি নি কিন্তু আমার নিশ্চয়ই এখনো মনে আছে, কিন্তু আমি আবৃত্তি করার কোন আগ্রহ দেখলাম না। আমি যদি এখন এই কবিতাটি আবৃত্তি করার চেষ্টা করি সেটা এতো বেখাপ্পা শোনাবে যে বলার মতো নয়। আমি এখন একটা দুষ্টু ও পাজী ছেলে–দুষ্টু এবং পাজী ছেলেরা কখনো কবিতা আবৃত্তি করে না।
জয়ন্ত প্রথমে সোনার তরী কবিতাটি শোনালো–ঠিক আবৃত্তি নয় মুখস্ত বলে গেলো। তারপর আমাদের ক্লাসের শিল্পী মৌটুসী আজি হতে শতবর্ষ পরে। কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনালো। মৌটুসীর গলা খুব ভাল, উচ্চারণও সুন্দর, তাই খুব সুন্দর শোনালো কবিতাটি। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম খুব খুশি হলেন শুনে। তখন প্রিয়াংকা হাত তুললো কিছু একটা বলার জন্যে। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন তুমি কোন কবিতাটা আবৃত্তি করতে চাও?
প্রিয়াংকা বলল, আমি আবৃত্তি করতে চাই না ম্যাডাম।
তাহলে?
আপনি আমাদের একটা কবিতা আবৃত্তি করে শোনান।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম অবাক হয়ে বললেন, আমি?
হ্যাঁ ম্যাডাম। প্রিয়াংকা খুব সহজ গলায় বলল, আপনার সবচেয়ে প্রিয় কবিতাটা একটু আবৃত্তি করে শোনাবেন প্লিজ!
প্রিয়াংকা মেয়েটা একটু অন্যরকম। এমনভাবে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের সাথে কথা বলছে যেন তার সাথে তার কতো দিনের পরিচয়, যেন ম্যাডাম আমাদের স্কুলের প্রিন্সিপাল নন, যেন আমাদের ক্লাসেরই আরেকজন। প্রিয়াংকা না হয়ে অন্য কোন একজন এই কথা বললে সেটা কিন্তু মোটেই এতো স্বাভাবিক শোনাতো না।