প্রিয়াংকা আমার জায়গায় হলে নিশ্চয়ই কী চমৎকার একটা উত্তর দিতে পারতো, আমি কিছুই বলতে পারলাম না। কী বলা যায় সেটা চিন্তা করতে করতে আবার নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম, আমি যদি পচা আপেল হই তাহলে স্যারও পচা আপেল।
আমার কথা শুনে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের চোখগুলো বড় বড় হয়ে উঠল। ম্যাডাম তার চশমাটা খুলে টেবিলে রেখে বললেন, ছেলে, তোমার কী মাথা খারাপ হয়েছে?
আমি মাথা নাড়লাম, না।
তাহলে?
আমি চুপ করে দাড়িয়ে রইলাম। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, তুমি এভাবে কথা বলছ কেন?
রাজাকার স্যার আমার জন্যে উত্তরটা দিয়ে দিলেন, বললেন, এই পাজী ছেলেটা এইভাবেই কথা বলে। এর মতো বেয়াদব ছেলে স্কুলে আর একটাও নাই।
আমি রাজাকার স্যারের দিকে না তাকিয়ে প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে বললাম, ম্যাডাম, আমাকে তো স্কুল থেকে তাড়িয়েই দিবেন, তাই যাওয়ার আগে আপনাকে সত্যি কথাটা বলে যাই।
রাজাকার স্যার চিৎকার করে বললেন, চোপ। চোপ বেয়াদব ছেলে-
আমি তখন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছি, আরও গলা উঁচিয়ে বললাম, এই স্যার ক্লাসে কখনো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোন কবিতা পড়ান না। এই স্যার মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে ক্লাসে টিটকারি মারেন। এই স্যার হিন্দু ছাত্রদের পিটান
রাজাকার স্যারের মুখটা ভয়ংকর রাগে কেমন যেন বিকৃত হয়ে গেল, ঘরে আর কেউ না থাকলে একেবারে নিশ্চয়ই আমাকে খুন করে ফেলতেন। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কেমন যেন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন, বললেন, তুমি কী বলছ ছেলে?
আমি সোজাসুজি প্রিন্সিপাল ম্যাডামের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি সত্যি কথা বলছি।
রাজাকার স্যার হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন, প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে বললেন, আপনি আমার সাথে আসেন ম্যাডাম। ক্লাসে গিয়ে জিজ্ঞেস করবেন
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম এক ধরনের অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর ঘুরে রাজাকার স্যারের দিকে তাকালেন, বললেন, তার কোন প্রয়োজন নেই সরকার সাহেব।
তাহলে, তাহলে–
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম এক ধরনের ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আমি ব্যাপারটা দেখছি। আপনি এখন আসুন।
রাজাকার স্যার হঠাৎ করে কেমন জানি চুপসে গেলেন। দাড়িয়ে থেকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন, ঠিক বলতে পারলেন না, একবার আমার মুখের দিকে তাকালেন তারপর বের হয়ে গেলেন।
আমি আর প্রিয়াংকা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম, প্রিন্সিপাল ম্যাডাম অন্যমনস্কভাবে টেবিলে আঙুল দিয়ে শব্দ করতে করতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। তাকে দেখে মনে হতে লাগলো যেন ভুলেই গেছেন আমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছি।
আমরা কী করব বুঝতে পারছিলাম না তখন ম্যাডাম আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা ক্লাসে যাও।
আমি আর প্রিয়াংকা প্রিন্সিপাল ম্যাডামের অফিস থেকে বের হয়ে এলাম।
০৪. কবিতা এবং মুক্তিযুদ্ধ
জ্যামিতির ক্লাস টেস্টে মামুন পেলো আশি, জয়ন্ত সত্ত্বর অন্যেরা তার থেকে অনেক কম। পরীক্ষাটি ছিল একেবারে পানির মতো সোজা আমি নিখুঁতভাবে প্রত্যেকটার উত্তর লিখেছি কিন্তু আমি পেয়েছি শূন্য। ক্লাস টেস্টের খাতা দেয়ার সময় স্যার বলেছেন আমাকে কেন শূন্য দিয়েছেন, আমি অন্যের খাতা দেখে লেখেছি বলে কোন নম্বর দেন নি। খাতা দেওয়ার সময় জ্যামিতি স্যার ন্যায় এবং সততার উপরে বড় একটা লেকচার দিলেন। অন্যের খাতা দেখে লিখলে কিছু যে শেখা যায় না উল্টো একজন অপরাধী হিসেবে বড় হতে হয়, চরিত্রের মাঝে হীনম্মন্যতা ঢুকে যায়–স্যার সেটাও খুব সুন্দর করে ব্যাখ্যা করে দিলেন।
সবই ঠিক আছে, কিন্তু একটিমাত্র সমস্যা–আমি কারো খাতা দেখে লিখি নি। জ্যামিতির উপপাদ্য আর সম্পাদ্যগুলো আমি নিজেই করেছি, স্যারকে আর সেটা বলার চেষ্টা করলাম না। তাহলে অন্যের খাতা দেখে লেখার সাথে সাথে মিথ্যা কথা বলার অপরাধটাও যোগ হবে! এমনিতেই নানারকম ঝামেলার মাঝে আছি তার মাঝে এই নতুন ঝামেলা শুরু করার কোন ইচ্ছে নেই। স্যার ক্লাসে উপপাদ্য এবং সম্পাদ্যগুলো বুঝিয়ে দিলেন, কয়েকটা আরো অনেক সহজভাবে করা যায়, স্যার সেটা জানেন না।
ক্লাসের শেষে প্রিয়াংকা আমার কাছে এলো, বলল, তপু।
আমি বললাম, কী?
তোমার ক্লাস টেস্টের খাতাটা আমাকে দেখাবে?
কেন?
কারণ আছে।
আমি বললাম, আমি শূন্য পেয়েছি। আমার খাতা দেখে কোন লাভ নাই। মামুন না হলে জয়ন্তের খাতাটা দেখো।
প্রিয়াংকা বলল, আমি তোমারটাই দেখতে চাই।
আমি আমার খাতাটা বের করে দিলাম। প্রিয়াংকা খানিকক্ষণ উল্টেপাল্টে দেখে খাতাটা আমাকে ফেরত দিয়ে বলল, তোমার সবগুলো ঠিক হয়েছে।
আমি মাথা নাড়লাম বললাম, হ্যাঁ।
স্যার বলেছেন তুমি অন্যের থেকে দেখে লেখেছ তাই তোমাকে শূন্য দিয়েছেন।
আমি আবার মাথা নাড়লাম, বললাম, হ্যাঁ।
ক্লাস টেস্টের দিনে আমি তোমার পিছনে বসেছিলাম আমি দেখেছি তুমি কারো খাতা দেখে লিখ নি। তুমি নিজে নিজে লিখেছ।
আমি এইবার একটু হাসলাম, বললাম, হ্যাঁ।
তুমি কেন সেটা স্যারকে বললে না?
আমি যদি বলতাম স্যার সেইটা বিশ্বাস করতো না। কোন ভাল জিনিসের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নাই–তুমি সেটা জানো না?
প্রিয়াংকা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, তুমি এতো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছ কেন?
আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
আমি ক্লাস টেস্টের খাতাটা ব্যাগের ভিতরে ঢুকিয়ে বললাম, এর মাঝে বোঝার কিছু নাই।