প্রিন্সিপাল ম্যাডাম একবার আমার দিকে আরেকবার প্রিয়াংকার দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, তোমাদের বিরুদ্ধে আমি যেটা শুনছি সেটা সত্যি?
আমি কিছু বললাম না, শুধু উদাস মুখে শরীরের ভরটা এক পা থেকে অন্য পায়ের উপর সরিয়ে নিলাম। প্রিয়াংকা খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে, সে বলল, আপনি কী শুনেছেন সেটা জানলে বলতে পারতাম ম্যাডাম।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম রাজাকার স্যারকে দেখিয়ে বললেন, তোমাদের এই স্যার বলেছেন, তোমরা তার সাথে খুব বড় বেয়াদবি করেছ।
প্রিয়াংকা ম্যাডামের কথা শুনে একটুও ঘাবড়াল না, বেশ হাসি হাসি মুখে বলল, স্যার যদি বলে থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই সেটা সত্যি। স্যারের কাছে নিশ্চয়ই মনে হয়েছে আমরা বেয়াদবি করে ফেলেছি। কিন্তু ম্যাডাম-
কিন্তু কী?
আমরা একটুও বেয়াদবি করতে চাইনি ম্যাডাম।
করতে না চাইলে সেটা কেমন করে হয়?।
রাজাকার স্যার হঠাৎ করে সোজা হয়ে বসে বললেন, আমি আপনাকে বলি কী হয়েছে। এই যে মেয়েটাকে দেখছেন, এ নতুন এসেছে। কোন স্কুল। থেকে এসেছে জানি না। ডিসিপ্লিনের খুব অভাব–ক্লাসে ঢুকেই দেখি পিছনের বেঞ্চে বসে কথা বলছে। আমি বললাম, সামনে এসে বসো। সে বলল বসবে না। কতো বড় বেয়াদব শুধু যে সামনে এসে বসল না তা না, আমার সাথে মুখে মুখে তর্ক জুড়ে দিল।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম শীতল চোখে প্রিয়াংকার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার কিছু বলার আছে মেয়ে?
প্রিয়াংকা একটু চোখ বড় বড় করে একবার প্রিন্সিপাল ম্যাডাম একবার রাজাকার স্যারের দিকে তাকাচ্ছিল, এক মুহূর্তের জন্যে একবার আমার দিকেও তাকালো। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম এবার ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করলেন, আছে কিছু বলার?
প্রিয়াংকা খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারে, ভাল ফুটবল খেলা বা ভাল গান গাইতে পারার মতো এটাও নিশ্চয়ই একটা বড় গুণ। আমি শুনলাম প্রিয়াংকা বলল, জি ম্যাডাম, আমার কিছু বলার তো নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু আমার মনে হয় কিছু না বলাটাই সবচেয়ে ভাল হবে।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ভুরু কুঁচকে বললেন, কেন? না বলাটা কেন ভাল হবে?
যদি আমি কিছু বলি সেটা অন্যরকম শুনাবে। মনে হবে, মনে হবে—
কী মনে হবে?
মনে হবে স্যার যে কথাটা বলছেন আমি সেটা অস্বীকার করছি।
রাজাকার স্যার এবারে কেমন যেন খেপে গেলেন, প্রায় টেবিলে থাবা দিয়ে বললেন, দেখেছেন? দেখেছেন কতো বড় বেয়াদব? বলার চেষ্টা করছে আমি মিথ্যা কথা বলছি-
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম হাত তুলে রাজাকার স্যারকে থামালেন। তারপর আমার দিকে ঘুরে তাকালেন, বললেন, আর তুমি? তুমি কী করেছ?
আমি কিছু না বলে দাড়িয়ে রইলাম। রাজাকার স্যার বললেন, এর কথা ছেড়ে দেন ম্যাডাম। একে যদি এখনই টি.সি. দিয়ে স্কুল থেকে বিদায় না করেন তাহলে কিন্তু স্কুলের বেইজ্জতি হয়ে যাবে।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ভুরু কুঁচকে রাজাকার স্যারের দিকে তাকালেন, কেন?
আর কয়দিন পরে এই ছেলে মানুষ মার্ডার করবে। এর চেহারাটা একবার দেখেন। এর কতো বড় সাহস, ক্লাসে আমাকে থ্রেট করে।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আমার দিকে ভাল করে তাকালেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, সত্যি?
আমি এবারেও কিছু না বলে দাড়িয়ে রইলাম। কথা না বলতে বলতে আমি ঠিক করে কথা বলতেই ভুলে গেছি। মুখ খুলে কিছু একটা বলতে গেলেই উল্টাপাল্টা কিছু একটা বলে ফেলব তখন আরো বড় ঝামেলা হয়ে যাবে। এর থেকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকাই ভাল।
রাজাকার স্যার থামলেন না, বললেন, আপনি নতুন এসেছেন তাই আপনি জানেন না। এ একসময়ে খুব ভাল ছাত্র ছিল। তারপর হঠাৎ করে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে বদমাইশ হয়ে গেলো–এখন পরীক্ষায় পাস করতে পারে না। দিনরাত রাস্তাঘাটে মারামারি করে। রীতিমতো গুণ্ডা। সন্ত্রাসী।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আবার আমার দিকে তাকালেন, খানিকক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, সত্যি?
আমি এবারেও কিছু বললাম না। এই পৃথিবীতে বিচার বলে যে কিছু নেই সেটা আমার থেকে ভাল করে কেউ জানে না, কাজেই প্রিন্সিপাল ম্যাডাম যে রাজাকার স্যারের কথা বিশ্বাস করে আমাকে টি.সি, দিয়ে বিদায় করে দেবেন সে ব্যাপারে আমার একটুও সন্দেহ নাই। তবে এখন তাতে আর কিছু আসে যায় না, আমি বাসা থেকে যখন পালিয়েই যাব তখন টি.সি. নিয়ে আর না নিয়ে পালিয়ে যাবার মাঝে পার্থক্য কী?
রাজাকার স্যার বললেন, এক ঝুড়ি আপেলের মাঝে একটা পচা আপেল থাকলে সব আপেল পচে যায়। এ হচ্ছে পচা আপেল, একে যদি এখনই বিদায় করেন পুরো ক্লাসকে কিন্তু নষ্ট করে দেবে।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আমার দিকে তাকালেন, তোমার কিছু বলার আছে?
আমার অনেক কিছুই বলার আছে কিন্তু আমি তো গুছিয়ে কথা বলতে পারব না। তবে সারা জীবনের জন্যে যখন চলেই যাচ্ছি তখন যা খুশি বলে দিলে ক্ষতি কী? আর কেউ তো কখনো এটা করতে পারবে না। আমি প্রিন্সিপাল ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বললাম, জি ম্যাডাম। বলার আছে।
কী বলার আছে?
আমাকে যদি বের করতেই হয় তাহলে ঐ স্যারকেও বের করে দিতে হবে।
কথাটা আমি ভেবে বলি নাই, বলে ফেলার পর কথাটা শুনে আমি নিজেই চমকে উঠলাম, বলেছি কী আমি? কিন্তু বলে যখন ফেলেছিই এটা তো আর ফিরিয়ে নেয়ার উপায় নেই। রাজাকার স্যারের চোয়ালটা কেমন যেন ঝুলে পড়ল, মাছের মতো খাবি খেলেন কয়েকবার। প্রিয়াংকা বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যে মনে হলো আমার কথা বুঝতে পারছেন না। খুব ধীরে ধীরে তার মুখটা পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেলো, শোনা যায় না এরকম গলায় আস্তে আস্তে বললেন, ছেলে, তোমার তো সাহস কম না, তুমি আমার সামনে দাড়িয়ে তোমার স্যারের সম্পর্কে এরকম একটা কথা বলো?