মামুন অনেক সময় লাগিয়ে সবগুলো গুণ করে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, পঁচিশ।
জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলল, গুড।
তারপর দুজন হেঁটে চলে গেলো। দুই অংকের আরেকটা সংখ্যা হচ্ছে ছিয়াত্তর, এই দুজন সেটা মনে হয় জানেই না। আমার একবার ইচ্ছে হলো জয়ন্ত আর মামুনকে ডেকে সেটা বলি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু বললাম না। এরা। হচ্ছে ক্লাসের ভাল ছেলে তারা জ্ঞানের কথাবার্তা বলে, আমি হচ্ছি ক্লাসের খারাপ ছেলে আমিও যদি তাদের সাথে জ্ঞানের কথাবার্তায় যোগ দিই তাহলে তারা ভড়কে যেতে পারে।
জয়ন্ত আর মামুন চলে যাবার পর আমি হঠাৎ করে আবিষ্কার করলাম দুই অংকের সংখ্যা পঁচিশ এবং ছিয়াত্তরের মতো তিন অংকেরও দুটি সংখ্যা আছে সেগুলো হচ্ছে তিনশ ছিয়াত্তর আর ছয়শ পঁচিশ। শুধু তাই না চার অংকেরও একটা সংখ্যা আছে সেটা হচ্ছে নয় হাজার তিনশ ছিয়াত্তর। এর চাইতে বড় সংখ্যাও আছে আমি সেটা ভেবে বের করতে যাচ্ছিলাম তখন হঠাৎ আমার একটা অন্য জিনিস মনে হলো। জয়ন্ত আর মামুন দুইজন হচ্ছে আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে ভাল ছাত্র, তাদের এই সহজ জিনিসগুলো বের করতে এতো সমস্যা হচ্ছে কেন? নাকি উল্টোটা সত্যি, যে জিনিসগুলো এতো সহজ নয়, কোন কারণে আমার কাছে সহজ মনে হচ্ছে? বিষয়টা কীভাবে পরীক্ষা করা যায়? কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারলে হতো, কিন্তু কাকে জিজ্ঞেস করব? আমার একমাত্র বন্ধু হচ্ছে বাসায় সেই নেংটি ইঁদুরটি। সে আসবে রাত দশটায়, তাকে যদি জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা মিচকি, বল দেখি কোন সংখ্যাকে সেই সংখ্যা দিয়ে গুণ করলে প্রথমে সেই সংখ্যাটা পাওয়া যায়? তখন সে কী করবে? বিষয়টা চিন্তা করেই আমার একটু হাসি পেয়ে গেলো।
আমি ক্লাসে বহুকাল কোন কিছুতেই মনোযোগ দিই না, আজকে জ্যামিতি ক্লাসে একটু মনোযোগ দিয়ে স্যারের কথা শোনার চেষ্টা করলাম এবং অবাক হয়ে লক্ষ করলাম স্যার ক্লাসে রীতিমতো হাস্যকর জিনিস পড়াচ্ছেন। অনেক কষ্ট করে একটা উপপাদ্য প্রমাণ করলেন যেটা অনেক সহজেই অন্যভাবে প্রমাণ করা সম্ভব কিন্তু আমি সেটা বলার চেষ্টা করলাম না। আমি অনেক দিন পর আমাদের গণিত বইটা উল্টেপাল্টে দেখলাম, ভিতরের বিষয়বস্তু আশ্চর্য রকম সহজ। আমি আবার একটা ধন্ধের মাঝে পড়ে গেলাম–বিষয়টা আসলেই সহজ নাকী আমার কাছে সহজ মনে হচ্ছে?
দুপুর বেলা ইংরেজি ক্লাস হচ্ছে তখন স্কুলের দপ্তরি কালীপদ ইংরেজি স্যারের কাছে একটা চিরকুট নিয়ে এলো। স্যার চিরকুট পড়ে ভুরু কুঁচকালেন, আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আরিফুল ইসলাম তপু আর প্রিয়াংকা চৌধুরী কে?
ক্লাসের দুই পাশ থেকে আমি আর প্রিয়াংকা উঠে দাঁড়ালাম। স্যার খানিকক্ষণ আমাদের দুজনকে একটু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন তারপর বললেন, তোমাদের দুইজনকে প্রিন্সিপাল ডেকে পাঠিয়েছেন।
সারা ক্লাসে আতংকের একটা ফিসফিসানি শোনা গেলো। আমাদের স্কুলের আগের প্রিন্সিপাল ছিলেন খুব হাসিখুশি মানুষ। মাসখানেক হলো নতুন প্রিন্সিপাল এসেছেন, তিনি মহিলা এবং কমবয়সী। তার চেহারা খুব সুন্দর কিন্তু সেটা যেন কেউ বুঝতে না পারে সেজন্যে একেবারে সাজগোজ করেন না। বুড়ো মানুষের একটা চশমা পরে থাকেন এবং সব সময় মুখটা পাথরের মতো। শক্ত করে রাখেন। আমরা শুনেছি এই ম্যাডাম নাকী অসম্ভব কড়া, আমাদের পুরো স্কুলটাকে এক মাসের মাঝে একেবারে ধনুকের ছিলার মতো সোজা করে ফেলেছেন! সেই প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আমাদের দুজনকে ডেকে পাঠিয়েছেন সেটা একটা ভয়ের ব্যাপার হতেই পারে।
ইংরেজি স্যার বললেন, যাও দেখা করতে যাও।
আমি আর প্রিয়াংকা দপ্তরি কালীপদের সাথে ক্লাস রুম থেকে বের হলাম। প্রিয়াংকা গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, ব্যাপার কী তপু? আমাদের ডেকেছে কেন?
রাজাকার স্যার নিশ্চয়ই নালিশ করেছে।
কী স্যার?
রাজাকার স্যার। আমি ব্যাখ্যা করলাম, বাংলা স্যারের নাম হচ্ছে। রাজাকার স্যার।
কেন?
কয়দিন থাকলেই বুঝতে পারবে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় নাকী রগ কাটতেন।
শুনে প্রিয়াংকা কেমন যেন চমকে উঠল। আমার দিকে এমন ভাবে তাকালো যে আমি বুঝতে পারলাম সে আমার কথা বিশ্বাস করে নাই। না করলে নাই–কয়দিন গেলে নিজেই বুঝতে পারবে।
প্রিন্সিপাল ম্যাডামের রুমে গিয়ে বুঝতে পারলাম, আমার ধারণা সত্যি। রাজাকার স্যার প্রিন্সিপাল ম্যাডামের সামনে একটা চেয়ারে বসে আছেন। কালীপদ বলল, আপা এই যে, এই দুইজন।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কী একটা কাগজ দেখছিলেন, সেটা সরিয়ে আমাদের দিকে তাকালেন। তার চোখের দৃষ্টি খুব পরিষ্কার, মুখে কিছু না বললেও চোখ দিয়ে বলছেন, তোমাদের মতো পাজী নচ্ছাড় বেয়াদব ছেলে-মেয়ে আমি অনেকবার দেখেছি, আগে আমি তাদের সিধে করে ছেড়ে দিয়েছি, তোমাদেরকেও সিধে করে ছাড়ব।
আমি আর প্রিয়াংকা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। বড় একটা টেবিল ঘিরে বেশ কয়েকটা চেয়ার। ভারি পর্দা, দেয়ালের সাথে লাগানো বেশ কয়েকটা শেলফ, সেগুলো বোঝাই বই দিয়ে। এক পাশে একটা আলমারি, সেখানে স্কুলের ছেলেমেয়েরা স্পোর্টস, ডিবেট, ছবি আঁকার কম্পিটিশান এসব করে যেসব কাপ, শিল্ড আর মেডেল এনেছে সেগুলি সাজানো আছে। আমি খারাপ হয়ে যাবার আগে যখন খুব ভাল ছিলাম তখন ডিবেট করে বড় একটা কাপ এনেছিলাম। সেই কাপটাও নিশ্চয়ই এখানে কোথাও আছে।