- বইয়ের নামঃ আমি তপু
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ পার্ল পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. একা একা
কোন কিছু বোঝার আগেই তপুর জীবনটা হঠাৎ করে পালটে গেলো চিরদিনের মতোই। দেখতে দেখতে তার আপনজনেরা দূরে সরে যেতে থাকে, এক সময় তপু আবিষ্কার করে সে একা। একেবারেই একা।
নিঃসঙ্গ কিশোরের এই দুঃসহ জীবনে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিল তার বিচিত্র সব সঙ্গী সাথী। তাদের নিয়ে সে কী পাড়ি দিতে পারবে তার বান্ধবহীন নিষ্ঠুর এই জীবন?
আমি তপু নিঃসঙ্গ এক কিশোরের বেঁচে থাকার ইতিহাস। নিষ্ঠুরতার ইতিহাস এবং ভালবাসার ইতিহাস।
০১. একা একা
আমার নাম তপু। ভাল নাম আরিফুল ইসলাম। আমি বি.কে. সরকারি হাই স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ি। আমাদের ক্লাসে এখন আটচল্লিশজন ছেলে-মেয়ে, তার মাঝে আমার রোল নম্বর পঁয়তাল্লিশ। আমি বেশি লম্বা-চওড়া না, মোটামুটি ছোটখাটো সাইজ। আমার বয়স তেরো কিন্তু নিজের কাছে মনে হয় আমার বয়স বুঝি চল্লিশের কাছাকাছি। আমি জানি কেউ আমার কথা শুনলে একটুও বিশ্বাস করবে না, বলবে, ক্লাস এইটে পড়ে একটা ছেলের কাছে খামোখা। নিজের বয়স চল্লিশ মনে হবে কেন? কিন্তু কথাটা সত্যি আমি একটুও বাড়িয়ে বলি নাই। আমার আব্বু যখন গাড়ি একসিডেন্টে মারা গেলেন তখন আমার বয়স ছিল দশ, আমি তখন পড়ি ক্লাস ফাইভে। তারপর তিন বৎসর পর হয়েছে, এই তিন বৎসরে আমি তিন ক্লাস ওপরে উঠেছি। কিন্তু আব্বু মারা যাবার পর প্রত্যেকটা বৎসর আমার কাছে মনে হয়েছে দশ বৎসরের মতো লম্বা একজন মানুষের দশ বৎসরে যে অভিজ্ঞতা হবার কথা আমার এক বৎসরেই সেই অভিজ্ঞতা হওয়া শুরু করল। তাই আমার সব সময় মনে হয় গত তিন বৎসরে আমার বয়স বেড়েছে তিরিশ বৎসর। সেই জন্যে বলছিলাম সব সময় আমার মনে হয় আমার বয়স প্রায় চল্লিশ। একজন চল্লিশ বছর বয়সের মানুষ যেভাবে চিন্তা করে আমিও মনে হয় সেইভাবে চিন্তা করি অনেকটা বুড়ো মানুষের মত। আমি যখন আসলেই বুড়ো হব তখন কী হবে কে জানে, তবে আমার মনে হয় সত্যি সত্যি বুড়ো হবার অনেক আগেই আমি মরে যাব।
কেন আমি এতো তাড়াতাড়ি বুড়ো মানুষের মতো হয়ে গেছি সেটা খুব বেশি মানুষ জানে না। যারা আমাকে বাইরে থেকে দেখে তাদের ধারণা আমার আব্বু মারা যাবার পর আমি বখে গিয়েছি। সেটা তারা ভাবতেই পারে, আমি তাদের একটুও দোষ দিই না। আগে আমি পড়াশোনায় অসম্ভব ভাল ছিলাম, শুধু যে পরীক্ষায়, ফার্স্ট হতাম তাই না, যে সেকেন্ড হতো সে কখনো আমার ধারেকাছে আসতে পারত না। এখন আমার পরীক্ষায় পাস করা নিয়েই ঝামেলা—আটচল্লিশজন ছেলেমেয়ের মাঝে কোনমতে টেনেটুনে আমি হয়েছি পঁয়তাল্লিশ নম্বর। আমার ধারণা সামনের বছর আমি পঁয়তাল্লিশ নম্বরও হতে পারব না, ক্লাস এইটেই আটকা পড়ে যাব। অঙ্ক ছাড়া আর কোন বিষয়ে আমি পাস করতে পারব না। আমি যে শুধু পড়াশোনাতে খারাপ হয়েছি তা না, আমার আচার-ব্যবহার স্বভাব-চরিত্র সবকিছু খারাপ হয়ে গেছে। আমি কারো সাথে ভাল করে কথা বলি না, খুব সহজে অন্যদের গালাগালি করতে পারি–ভয়ংকর ভয়ংকর খারাপ গালি আমি শিখে গেছি। শুধু যে গালাগালি করতে পারি তা না, মারামারিও করতে পারি। আমার গায়ে যে খুব জোর তা না–কিন্তু মারামারি করার জন্যে আসলে বেশি গায়ের জোর দরকার হয় না, যেটার দরকার সেটা হচ্ছে সাহস। সেটা আজকাল আমার ভালই হয়েছে বড় ক্লাসের ছেলেদেরকেও আমি মাঝে মাঝে ধামকি-ধমকি দিয়ে ফেলি। আমাদের ক্লাসের ভাল ছেলেরা আমার কাছেই আসে না, আর মেয়েদের কথা তো ছেড়েই দিলাম–আমি যদি কখনো তাদের চোখের দিকে তাকাই তাহলেই তারা মনে হয় ভয়ের চোটে ভ্যা করে কেঁদে ফেলবে।
আমি নোংরা কাপড় পরে স্কুলে আসি, চুল থাকে উষ্কখুষ্ক চেহারার মাঝে সবসময় একটা হতচ্ছাড়া ভাব থাকে, আমাকে দেখে আজকাল কেউ কল্পনাও করতে পারবে না যে আমি এক সময় স্কুলের নিখুঁত একটা ভাল ছেলে ছিলাম। কবিতা আবৃত্তি করতাম, ডিবেট করতাম, এমনকী স্কুলের বার্ষিক নাটকে আমি ছোট রাজপুত্রের অভিনয় করে একবার রুপার মেডেল পর্যন্ত পেয়েছিলাম। আমার বড় আপু কিংবা ভাইয়া এখনো নিখুঁত ভালো মেয়ে আর নিখুঁত ভালো ছেলে শুধু আমি অন্য রকম। আমার বড় আপুর নাম ঈশিতা, এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। শাড়ি পরে আপু যখন ইউনিভার্সিটিতে যায় তখন পাড়ার ইউনিভার্সিটি-কলেজে যাওয়া ছেলেরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে আর লম্বা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আমার ভাইয়ার নাম রাজীব, সে যখন কলেজ থেকে এসে একটা টি শার্ট পরে ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে খেলতে বের হয় তখন কম বয়সী মেয়েরা চোখের কোণা দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে নিজেরা একজন আরেকজনের সাথে ফিসফিস করে কথা বলে খিলখিল করে হাসে। শুধু আমি অন্য রকম–আমার দিকে কেউ ঘুরে তাকায় না। যারা আমাদের ভাল করে চিনে না তাদের ধারণা আমার আম্মুর দুই ছেলে-মেয়ে, আপু আর ভাইয়া। আমি তাদের খুব দূর সম্পর্কের কোন গরিব হতভাগা আত্মীয়ের বখে যাওয়া ছেলে আর তারা দয়া করে আমাকে তাদের বাসায় থাকতে দিয়েছে। প্রথম প্রথম পুরো ব্যাপারটা নিয়ে আপু আর ভাইয়া খুব অস্বস্তি বোধ করত, আজকাল করে না। অনেক দিন হলো মেনে নিয়েছে–ধরেই নিয়েছে তারা হলো আমার আম্মুর সত্যিকারের ছেলে-মেয়ে আর আমি তাদের আপন ভাই হয়েও বাইরের একজন মানুষ।