আপা, দিতেই হবে।
ধার, ধার আর ধার। কোনোদিন একটা পয়সা ফেরত দিয়েছিস?
এবারেরটা দেব। অনেষ্ট। আপা অন্য গড। অবশ্যই ফেরত দেব।
আর দিবি! তোদের আমি চিনি না? হাড়ে হাড়ে চিনি। কত দাম শার্টের?
তিনশ।
মিথ্যা কথা বলছিস। ঠিক করে বল কত?
আড়াই শ!
আশ্চর্য তোদের স্বভাব। এর মধ্যেও ট্রিকস করে পঞ্চশ টাকা হাতিয়ে নেবার মতলব?
তিনশ চাচ্ছে আড়াই শতে দেবে।
বড় আপা সুটকেস খুলে তিনটা একশ টাকার নোট বের করে গম্ভীর গলায় বললেন, এক্ষুণি পঞ্চাশ ফেরত দিয়ে যাবি। আমি কিন্তু বসে থাকব।
সুটকেস গুছাচ্ছিলে, ব্যাপার কী?
ভাবছিলাম ফ্ল্যাটে চলে যাব।
কেন?
ইস্তিয়াকের গায়ে চর্বি বেশি হয়েছে। আমাকে আইন দেখায়। মুসলিম আইনে বসতবাড়ি ভাগ হয় না। কে চায় তোর বসতবাড়ি? আমাকে এসব বলার অর্থ কী? আমি কি গাছ। তলায় আছি? চৌদ্দ লাখ টাকা নগদ গুনে ফ্ল্যাট কিনেছি। ব্যাংক থেকে একটা পয়সা নেই নি।
তা তো ঠিকই।
আমাকে অপমান করে আইন দেখায়। ভালো করে বল যে, আপা, এই বাড়িটা আমাদের তিন ভাইয়ের থাকুক। তোমার তো বাড়ি আছেই। তা না, ফারাজী আইন। আইনজ্ঞ এসেছেন।
ঠাশ করে গালে একটা চড় লাগালে না কেন?
বড় আপা আরো খুশি হয়ে গেলেন। আমি বললাম, সত্যি সত্যি যদি লিমিটেড কোম্পানি হয় সবাইকে নিয়েই হবে, পাওয়ার অব এটর্নি থাকবে তোমার কাছে। কারণ তুমি সবার বড়।
এই সাধারণ কথা গাধাটার মাথায় ঢুকলে তো কাজই হত।
বড় আপা মেয়ে দুটির দিকে তাকিয়ে ধমক দিলেন, তোরা এখানে সঙের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
আমরা যাচ্ছি না মা?
না?
মেয়ে দুটি এক সঙ্গে এমন প্ৰচণ্ড চিৎকার দিল যে ঘরের জানালা পর্যন্ত কেঁপে গেল। এরকম দুটি মেয়েকে বড় করতে আপার জীবন পানি হয়ে যাচ্ছে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
যাই আপা।
যা। টাকাটা দিয়ে যাস কিন্তু।
দুই-একদিন পরে দেই আপা?
বড় আপার খুশিখুশি ভাব আরো প্রবল হল। যদিও বিরক্ত গলায় বললেন, একবার তোর হাতে টলকা চলে গেছে, এই টাকা কি ফেরত আসবে? অভ্যাসটা বদলা। একবার অভ্যাস হয়ে গেলে যার-তার কাছে টাকা চাইবি। টাকা ধার চাওয়া আর ভিক্ষা চাওয়া একই।
তোমার কাছে ভিক্ষা চাওয়াতে কোনো অসুবিধা নেই।
বড় আপার মনের সব গ্রানি ধুয়ে-মুছে গেল। তিনি সুটকেস থেকে কাপড় নামিয়ে রাখছেন। আমি বললাম, তোমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছি। এটা আবার কাউকে বলবে না।
আচ্ছা যা, বলব না।
আমার শেষ কথাটাও তাকে খুশি করার জন্যে বলা। আপাকে কিছু গোপন করতে বললেও তিনি খুব খুশি হন। এবং কথাটা জনে জনে বলে বেড়ান। আজ সন্ধ্যার মধ্যে আমাদের পরিবারের সব সদস্যই জানবে যে, তিনি আমাকে শার্ট কেনার জন্যে তিনশ টাকা দিয়েছেন। আসল দাম আড়াই শ। ফাঁকি দিয়ে পঞ্চাশ বেশি নিয়েছি। পুরো ঘটনা বলার পর বলবেন, থাক, ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা না করাই ভালো। বেচারা লজ্জা পাবে। আমাকে বলেছে কাউকে না জানাতে।
একটি অলিখিত নিয়ম
আমাদের বাসার একটি অলিখিত নিয়ম হচ্ছে—পুরুষরা আলাদা খাবে, মেয়েরা আলাদা। রাতের খাবার খেতে বসেছি। আমি, বাবা এবং মোজোভাই। বুনোভাই খবর পাঠিয়েছেন তিনি নিজের ঘরেই খাবেন। তাকে যেন খাবার পাঠিয়ে দেয়া হয়। ভাগ্যিস মা এই হুকুম শুনতে পান নি। শুনতে পেলে হইচই বেঁধে যেত। বাধরুমে পড়ে গিয়ে মা কোমরে ব্যথা পেয়েছেন। মুখে বলছেন তেমন কিছু না কিন্তু তার ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছে অবহেলা করার মতো ব্যথা না।
খাবার-দাবার তদারক করছেন বড় আপা। আজকের সমস্ত রান্না তার। প্রতিটিতেই লবণ কম হয়েছে। এই খবরটা বললে, তিনি কেন্দেকেটে একটা কাণ্ড করবেন। আমরা কিছু বলছি না। শুধু বাবা বলে ফেললেন, বিনা লবণে রাধা ব্যাপারটা কী বল তো?
আপা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ইচ্ছে করে লবণ কম দিয়েছি।
ইচ্ছে করে কম দিবি কেন?
তোমার জন্যেই কম দিলাম। লবণ খেলে প্রেসার বাড়ে।
জিনিসটা মুখে তো দিতে হবে। ভাত খেতে বসেছি, ওষুধ তো খেতে বসি নি।
বড় আপার মুখ কালো হয়ে গেল। বাবা খাবার রেখে উঠে পড়লেন। এরকম তিনি কখনো করেন না। তাঁর আজ মনটা ভালো নেই। বড় আপা থমথমে গলায় বললেন, বস, ডিম ভেজে দিচ্ছি।
বাবা বসলেন না। হনাহন করে চলে গেলেন। মেজোভাই হাসিমুখে বলল, আমার কাছে তো লবণ পারফেক্ট বলে মনে হচ্ছে। এমন চমৎকার একটা তরকারি বাদ দিয়ে ডিম দিয়ে ভাত খাব? বড় আপা বললেন, রঞ্জু, তোর কাছেও কি লবণ কম মনে হচ্ছে? আমি হাসিমুখে বললাম, না, তো। ঠিকই তো আছে।
তাহলে বাবা এরকম করল কেন?
বাবার শরীর ভালো না।
বড় আপা চিন্তিত স্বরে বলল, আসলেই তাই। কাল রাতে রিমিকে বাথরুম করাতে নিয়ে যাচ্ছি— দেখি বারান্দায় একটা মোড়ার উপর বাবা চুপচাপ বসে আছেন। আমি বললাম, এখানে বসে আছ কেন? বাবা বিড়বিড় করে কী-সব বলল, বুঝলামও না। তরকারিটা ভালো হয়েছে?
অসাধারণ!
রংটা সুন্দর হয়েছে। কেমন টকটকে লাল। কীভাবে হল বল তো?
জানি না। কীভাবে?
রান্না শেষ হবার পর আধ চামচ ফুড কালার দিয়েছি। তোর দুলাভাই ব্যাংকক থেকে এনেছিল। আধ চামচ দিলেই রক্তের মতো লাল হয়ে যায়।
আমি বললাম, রক্তের মতো লাল হওয়াটা কি ভালো? মনে হবে না রক্ত খাচ্ছি?
দূর পাগলা।
পরিবেশ হালকা হয়ে গেল। আমাদের সঙ্গে নীতু এসে খেতে বসল। বিকেলেই নীতুর সঙ্গে মেজোভাইয়ের কঠিন ঝগড়া হয়েছে–সেই ঝগড়ার কথা এখন আর নীতুর মনে নেই। এই বয়সী মেয়েদের মন নদীর পানি মতো। কোনো কিছুই এরা জমা করে রাখে না। ভাসিয়ে নিয়ে যায়। নীতু বেশ হাসিমুখে মেজো ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করছে।