বুনোভাইয়ের কথা আমি পুরোপুরি অগ্রাহ্য করলাম না। বাবার দিকে খানিকটা লক্ষ রাখলাম। তেমন কিছু চোখে পড়ল না, সহজ স্বাভাবিক মানুষ। তাকে বাড়ির পেছনের ফাঁকা জায়গাটায় বেশির ভাগ সময় কাটাতে দেখা গেল। একদিন এগিয়ে গিয়ে বললাম এখানে কী করছ? তিনি বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, কিছু না, বসে আছি।
রোদে বসে আছ যে?
এমনি। দাঁতে ব্যথা–এই জন্যে।
দাঁতে ব্যথা হলে কেউ রোদে বসে থাকে? চল ডাক্তারের কাছে। যাই।
বাদ দে।
বাদ দেবে কেন চল যাই।
সেদিন বিকেলই ডেনটিষ্টের কাছে নিয়ে গেলাম। ডেনটিস্ট প্রথম দিনেই দুটা দাঁত টেনে তুলে ফেলল। সাধারণত ডেনটিস্টরা তা করে না, প্রথমে কিছু ওষুধপত্র দেয়। মনে হয় এ ডেনটিস্টের ধৈর্য কম।
রিকশায় করে ফেরার পথে তাকিয়ে দেখি বাবার গাল ফুলে ঢোল হয়ে আছে।
বাবা, ব্যথা করছে।
হুঁ।
এত তাড়াতাড়ি তো ব্যথা শুরু হবার কথা না।
বাবা নিচু গলায় বললেন, শরীরের ব্যথা কিছুই না। শরীরের ব্যথার জন্যে ওষুধপত্র আছে। ডাক্তার-কবিরাজ আছে মনের ব্যথার কিছুই নেই।
কিছু নেই তাও ঠিক না, বাবা। মনের অসুখের ডাক্তারও আছে।
অসুখের কথা তো বলছি না। মনে ব্যথার কথা হচ্ছে। মনের অসুখ আর মনের ব্যথা দুটা দুই জিনিস।
তোমার মনে কোনো ব্যথা আছে?
থাকবে না কেন? আছে। সবার মনেই অল্পবিস্তর আছে। আমারও আছে।
কী নিয়ে ব্যথা?
এই যে মইনুদিনের বাড়ি নিয়ে এত বড় অন্যায় কাজটা করলাম। বেচারার কাছ থেকে টাকা-পয়সা এনে খরচ করে ফেললাম। রেলিং দিলাম না, ছাদে ঘর করলাম না। দারোয়ান আর মালির ঘরটাও হল না।
উনি তো আর সেই খবর পান নি।
যখন বেঁচেছিল তখন পায় নি। এখন পাচ্ছে। মৃত মানুষ সব জায়গায় যেতে পারে। সবকিছু দেখতে পারে। সে তো এখন সব কিছুই দেখছে। এই যে আমরা রিকশা করে যাচ্ছি হয়তো সেও যাচ্ছে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে।
বাবা চুপ করে গেলেন।
বুনোভাইয়ের কথা মনে হচ্ছে পুরোপুরি ভুল না। বাবার মনের মধ্যে কোনো একটা গণ্ডগোল হয়েছে। আমরা যারা তার চারদিকে ঘোরাঘুরি তাদের কারো চোখে পড়ছে না। আর যে লোকটি দরজা বন্ধ করে সরক্ষণ পা নাচিয়ে খবরের কাগজ পড়ছে সে সব জেনে বসে আছে, আশ্চর্য তো!
চা খাচ্ছি
আমি এবং মেজোভাই একসঙ্গে বসে চা খাচ্ছি। নীতু এসে ডাকল, ভাইয়া। আমরা দুজন একসঙ্গে বললাম, কী?
নীতু আমাদের দুজনকেই ভাইয়া ডাকে। আমরা দুজন এক সঙ্গে থাকলে খুব মুশকিল হয়। ভাইয়া ডাকলে একসঙ্গে বলি, কী। নীতু হেসে গড়িয়ে পড়ে। আজ হাসল না। মুখ কালো করে বলল— বাবা যেন কী রকম করছেন। আমরা ছুটে গেলাম। বাবা দিব্যি ভালো মানুষের মতো দোতলার বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে আছেন। চশমার কাচ পঙ্কিার করছেন। আমাদের হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখে বললেন, কী ব্যাপার?
আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম।
মেজোভাই বললেন, আপনার শরীর কেমন?
আমরা সবাই বাবাকে তুমি করে বলি। মেজোভাইও বলেন। তবে তিনি কেন জানি মাঝে মাঝে আপনি বলেন।
বাবা বললেন, আমি তো ভালোই আছি। দাঁতের ব্যথা এখন আর নেই।
মেজোভাই বললেন, এখানে বসে কী করছেন?
বসে থেকে কী আর করা যায়! চশমার কাচ পরিষ্কার করছি। কেন বল তো?
না, এমনি জিজ্ঞেস করছি।
ইস্তিয়াক, তোর পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?
মোজোভাই বললেন, ভালো হচ্ছে।
পরীক্ষা কবে?
এখনো দেরি আছে।
কত দেরি?
ধর মাসখানিক ৷
মাসখানিক আর দেরি কোথায়? ত্ৰিশদিন। মাত্ৰ সাত শী বিশ ঘণ্টা। আর সময় নষ্ট করবি না। এখন খানিকটা কষ্ট করলে বাকি জীবন তার ফল ভোগ করবি।
নিতান্তই সহজ স্বাভাবিক কথাবার্তা। বাবারা যেসব কথা ছেলেদের বলেন–সেসব কথা। আমরা দুজন নিচে নেমে নীতুকে খুঁজে বের করলাম। মেজোভাই বিরক্তমুখে বললেন, সব সময় ফাজলামি করিস কেন?
নীতু মুখ কালো করে বলল, ফাজলামি করব কেন? আমি ঘর পরিষ্কার করছি, বাবা আমাকে ডেকে বারান্দায় নিয়ে গেলেন। ফিসফিস করে বললেন, সর্বনাশ হয়েছে। মইনুদিন বসার ঘরে বসে আছে। আমি কোন লজ্জায় তার সামনে পড়ব বল? তুই তোর মাকে নিয়ে যা। বল যে আমরা এই বাড়ি ছেড়ে দেব। টাকা-পয়সা যা নিয়েছি। সব তো আর একসঙ্গে দিতে পারব না, বাই ইন্সটলমেন্ট দিয়ে দেব। আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবি আমি বাসায় নেই। বলবি আমি দেশের বাড়ি গিয়েছি। যা, তাড়াতাড়ি যা। তোর মাকে সঙ্গে করি নিয়ে যা।
মেজোভাই বলেন, তুই এসব বসে বসে বানিয়েছিস। বাবা কখনো এরকম কিছু বলে নি।
নীতু রেগে গিয়ে বলল, আমি শুধু আজেবাজে কথা বানাতে যাব কেন? বাবাকে পাগল বানিয়ে আমার লাভ কী?
লাভ-ক্ষতি জানি না। তুই কথা একটু বেশি বলিস। কথা। দয়া করে কম বলবি।
কথা তুমিও বেশি বল। তুমিও দয়া করে কথা কম বলবে।
আমি কথা বেশি বলি?
হ্যাঁ, বেশি বল। বড়। আপাকে কী নাকি বলেছি–বড়। আপা আজ চলে যাচ্ছে। বাচ্চাদের নিয়ে একা এক ফ্ল্যাটে থাকবে।
আমি তো কিছুই বলি নি।
অবশ্যই বলেছ।
কী বলেছি?
বলেছ, বসতবাড়ি মুসলিম আইনে মেয়েরা পায় না। পায় ছেলেরা। কাজেই এই বাড়ি তোমরা তিন ভাই পাবে। একটা লিমিটেড কোম্পানি হবে। সেই কোম্পানি সদস্য হবে শুধু ছেলেরা। একজনের কাছে থাকবে পাওয়ার অব এটর্নি, সেই কোম্পানি দেখাশোনা করবে। বল নি এসব কথা?
হ্যাঁ, বলেছি। তাতে অন্যায়টা কী হয়েছে? আইনে যা আছে তাই বলেছি।