মা বললেন, বড় কিছুই হবে নয়তো কি আর চিকিৎসার জন্যে আমেরিকা গেছে। বাবা বললেন, দ্যাটস ট্রু। তাছাড়া ও নিজে চিঠি পর্যন্ত লেখে নি। সবার কাছে দোয়া চাচ্ছে— উফ! আমি তো সহ্য করতে পারছি না।
মা বললেন, তুমি মৌলানা সাহেবকে ডেকে একটা মিলাদের ব্যবস্থা কর।
মা জিতু মিয়াকে দিয়ে মুরগি আনিয়ে ছদগা দিলেন। বাসায় একদিন মিলাদও হল। একজন উটকো ধরনের মওলানা এসে নবী-এ করিমের জীবনের যাবতীয় ঘটনা তুলে দুঘণ্টা লাগিয়ে বর্ণনা করলেন। এত বিরক্ত লাগছিল যে বলার না। কিন্তু ধর্মীয় ব্যাপার বিরক্তি প্ৰকাশ করা যায় না বলে মুখ বুজে সহ্য করেছি।
এক মাস পর আমেরিকা থেকে মইনুদ্দিন চাচার মৃত্যুসংবাদ এল। তাঁর যকৃতে ক্যানসার হয়েছিল। সিরোসিস অব লিভার। বাবা খনিকক্ষণ কাঁদলেন, হয়তো আন্তরিকভাবেই তিনি দুঃখিত হয়েছিলেন। কারণ মইনুদ্দিন চাচা তার একেবারে ছেলেবেলার বন্ধু। তাঁদের দুজনের নিশ্চয়ই অনেক সুখস্মৃতি আছে। সবচে বেশি কাঁদল নীতু। সে কাঁদতে কাঁদতে চোখ-মুখ ফুলিয়ে ফেলল— কারণ মইনুদিন চাচা নীতুকে খুবই আদর করতেন। নীতু যখন ক্লাস টু-থ্রিতে পড়ত তখন মইনুদিন চাচা তাকে প্রায় স্কুল থেকে নিয়ে গাড়িতে করে ঘুরতেন। তিনি তখন নতুন গাড়ি কিনেছে, নীতুর এই গাড়ি খুব পছন্দ।
মইনুদিন চাচা প্রায়ই নীতুকে বলতেন, মা, তোর গাড়ি এত পছন্দ, তোকে আমি তোর বিয়ের সময় একটা গাড়ি প্রেজেন্ট করব। তোকে কথা দিলাম রে মা। নীতু কচি কচি গলায় বলত, আপনি ভুলে যাবেন না তো চাচা?
না, ভুলব না। আমি কিছুই ভুলি না রে মা। আমার স্মৃতিশক্তি অসাধারণ।
বিয়েতে সে গাড়ি পাবে না। এই শোকে নীতু নিশ্চয়ই কাঁদে নি— তার দুঃখে কোনো খাদ ছিল না। মইনুদিন চাচা তাকে যেমন পছন্দ করতেন সেও তাকে তেমনি পছন্দ করত। আমরা তাঁর মৃত্যুতে সত্যিকার অর্থে ব্যথিত হলাম। তাঁর মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার আর দুমাস পর যখন তাঁর মেয়ে আমেরিকা থেকে জানাল— তার বাবা মৃত্যু সময় বলে দিয়েছেন ঢাকার যে বাড়িতে আমরা আছি–সেই বাড়িটা যেন আমরাই পাই এই ব্যবস্থা করতে। কীভাবে কী করতে হয় তা সে জানে না। তার মার শরীরও ভালো না। তার দেশে এসে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করবে।
এই চিঠি পেয়ে সত্যিকার অর্থেই আমরা অভিভূত হলাম। মইনুদিন চাচা তাঁর এক জীবনে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন। তবে তার মানে এই না যে, তিনি আস্ত একটি বাড়ি ছেলেবেলার বন্ধুকে দিয়ে দেবেন। কেউ তা দেয় না। গল্প, উপন্যাস বা সিনেমায় হয়তো দেয় বাস্তবে না।
এই বাড়ি আমাদের না
শুরুতে আমি বলেছিলাম যে, এই বাড়ি আমাদের না, আমরা এই বাড়ির কেয়ারটেকার— এটা আর প্রযোজ্য নয়। এ বাড়ির এখন আমরাই মালিক। দরিদ্র মধ্যবিত্ত এখন আর আমাদের বলা চলে না। আমরা ঢাকা শহরে আস্ত একটা দোতলা বাড়ির মালিক। কাগজপত্রও এখন আমাদের কাছে আছে। দানপত্র রেজিস্ট্রি হয়েছে। আইনের কোনো ফাঁক নেই। আমার ইনজিনিয়ার মেজোভাই ইতোমধ্যেই চিন্তাভাবনা শুরু করেছে এই বাড়ি ভেঙে সাততলা একটি কমপ্লেক্স হবে। পুরো বাড়িটা হবে আরসিসির উপর। একতলায় থাকবে গ্যারেজ, শপিং মল, লন্দ্রি। অ্যাপার্টমেন্ট। এই বিশাল কমপ্লেক্সের জন্যে বাড়তি কোনো ব্যাংক লোনেরও প্রয়োজন হবে না। কিছু কিছু অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করে দিলেই টাকাটা উঠে আসবে। প্ৰায় এক বিঘা জমির উপর বাড়ি। জমির দামই ত্রিশ-চল্লিশ লাখ টাকা। আমরা এক ধাক্কায় অনেক দূরে উঠে গেলাম।
দূরে ওঠা মানুষদের কাছে পৃথিবী অনেক ছােট মনে হয়— আমাদেরও সে রকম মনে হওয়া উচিত ছিল। আমাদের সবারই আচার-আচরণ এবং মানসিকতা খানিকটা হলেও বদলানো উচিত। আশ্চর্যের ব্যাপার, তেমন বদলাল না। বড় ভাই আগের মতোই একটা খবরের কাগজ হাতে নিয়ে পা নাচাতে লাগলেন। মা সবার সঙ্গে সমানে ঝগড়া করে যেতে লাগলেন। নীতু নিজেকে তরুণী হিসেবে জাহির করার জন্য আগের মতোই ব্যস্ত রইল। তবে কিছুটা পরিবর্তন যে হল না তা না। যেমন, হয়তো দেয়ালে পেরেক পুতছি, মা ছুটে এসে বললেন, এসব কী, দেয়াল জখম করছিস কেন? যেন এই বাড়ি এখন আর বাড়ি না— এটা এখন মানুষ। এর প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এর দেয়াল জখম করলে এ ব্যথা পায়। অবশ্যি এই বাড়ি মেজোভাইকে বেশ খানিকটা বদলে দিল। একদিন দেখি গজফিতা নিয়ে জমি মাপামাপি হচ্ছে। সঙ্গে বিষন্ন চেহারার বুড়ো একজন মানুষ। আমি দোতলার জানালা থেকে দেখলাম, মেজোভাই হাত নেড়ে নেড়ে বুড়োকে কী যেন বলছে। একদিন আমাদের তিন ভাইকে নিয়ে তিনি একটা মিটিংও বসালেন। তার ভাবভঙ্গি থেকে মনে হল গুরুত্বপূর্ণ মিটিং। দরজা ভিড়িয়ে দিলেন। তার গলার স্বর নিচে নেমে গেল। বুনোভাই পা নাচানো বন্ধ করে বিস্মিত স্বরে বললেন, তুই এরকম করে কথা বলছিস কেন? তো কী হয়েছে? এনিথিং রং?
মেজোভাই বিরক্ত স্বরে বললেন, কিছু হয় নি। আমি কী বলতে চাচ্ছি। দয়া করে মন দিয়ে শোন। এই যে প্ৰপাটি আমরা পেয়েছি। এর ডেভেলপমেন্টের ব্যাপারে তোমারা কী ভাবিছ সেটা প্ৰথমে আমি জানতে চাই। তারপর আমার কিছু কথা আছে, যা আমি বলতে চাই। বুনোভাই প্রথমে তুমি বল।
বুনোভাই উঠে বসতে বসতে বললেন, আমার কাছে মনে হচ্ছে আমরা একটা ফরম্যাল মিটিং করছি। যদি তাই হয় তাহলে একজন সভাপতি ঠিক করা দরকার। কে হবে সভাপতি? আমি তোর নাম প্ৰস্তাব করতে পারি করব? মেজোভাই রাগী স্বরে বললেন, আজেবাজে কথা বলার আমি কোন অর্থ দেখছি না। লেট আস ডিসকাস।