বাবা মার দিকে তাকালেন। এমনিতে মার কথার যন্ত্রণাতে থাকতে পারি না। আজ তাঁর মুখেও কথা নেই। তিনিও সম্ভবত চোখে অন্ধকার দেখছেন।
আমার নিজের বেশ মন খারাপ হল। এই চমৎকার শাদা বাড়িটি ছেড়ে দিয়ে আবার দুই রুমের ফ্ল্যাটে উঠতে হবে। থাকব কী করে? দম বন্ধ হয়ে আসবে।
মেজোভাই বললেন, ইনি বেড়াতে আসছেন। বাড়ি দখল নেয়ার জন্যে তো আসছেন না। কাজেই আমরা এখন যেমন আছি, পরেও থাকব। আমি তো কোনো সমস্যা দেখছি না।
বাবা শুকনো মুখে বললেন, কিন্তু সে যখন দেখবে কাজ-টাজ কিছুই হয়নি। তখন…
মেজোভাই বললেন, তখন আবার কী? রাগারাগি-হইচই করবে। তাই বলে তো বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারবে না? এভিকশন এত সহজ না, খুব কঠিন।
বাবা অবাক হয়ে বললেন, জোর করেও ন্যের বাড়িতে থাকব নাকি?
দরকার হলে থাকতে হবে।
থানা-পুলিশ করবে। বিশ্ৰী ব্যাপার।
থানা-পুলিশ করলে আমরাও থানা-পুলিশ করব। থানা-পুলিশ কি উনার একার নাকি? আমাদের রাইট অব পজেশন আছে না? আইন আমাদের পক্ষে।
বুনোভাই এই পর্যায়ে বললেন, তোর কথাবার্তা তো আমি কিছুই বুঝছি না। বেচারা এতদিন থাকতে দিয়েছে, থেকেছি। এখন চলে যেতে বললে চলে যাব না? এ কেমন কথা?
যাবে কোথায় তুমি? যেখানেই হোক যেতে হবে। আমার তো মনে হয় যে টাকাটা ভদ্রলোক পাঠিয়েছিলেন সেটা যোগাড় করে রাখলে… মানে উনাকে টাকাটা দিয়ে যদি
মেজোভাই তিক্ত গলায় বললেন, টাকাটা থাকতে হবে তো? বাবা, তোমার কাছে কি টাকা আছে?
বাবা জবাব দিলেন না। সেই সময় হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠল। দেখা গেল বাবা দারুণ চমকে উঠেছেন। না, মইনদিন চাচা না–শ্রাবণী এসেছে। মেজোভাই মিটিং ফেলে উঠে গেলেন।
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে অসহায়ভাবে বললেন, রঞ্জু, কী করা যায় বল তো?
আমি পরিবেশ সহজ করার জন্যে হালকা গলায় বললাম, চল, আমরা সবাই মিলে আলাদীনের চেরাগের সন্ধানে বের হই। রসিকতা হিসেবে এটা যে খুব উচ্চমানের তা না। তবে নীতু হেসে ভেঙে পড়ল। হাসির ফাঁকে ফাঁকে অনেক কষ্টে বলল, ভাইয়া যা হাসাতে পারে। বাবা বেশ কয়েকবাম কঠিন দৃষ্টিতে নীতুর দিকে তাকালেন। নীতুর হাসি বন্ধ হল না।
মা উঠে এসে আমাদের সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে প্ৰচণ্ড চড় বসিয়ে দিলেন নীতুর গালে। নীতু বড় অবাক হল, তবে সম্ভবত পরিস্থিতি গুরুত্ব খানিকটা বুঝল। কারণ কেঁদে ফেলল। না বা উঠে চলেও গেল না। শুকনো মুখে বসে রইল।
যাই হোক, বাবার এবং সেই সঙ্গে আমাদের সবার সমস্যার সমাধান হঠাৎ করেই হয় গেল। মইনুদিন চাচার মেয়ের এক রেজিস্টার্ড চিঠি এসে পড়ল। ইংরেজিতে লেখা চিঠি, যার সরল বাংলা–আমার আব্বার শরীর ভালো না। হঠাৎ খুব খারাপ করেছে তাকে চিকিৎসার জন্যে আমেরিকা নিয়ে যাচ্ছি। কাজেই এখন তিনি আর দেশে যেতে পারছেন না। বাবা আপনাদের তার জন্যে দোয়া করতে বলেছেন। দয়া করে দোয়া করবেন।
ইতি— তানিয়া।
তানিয়া মইনুদিন চাচার বড় মেয়ে। বয়সে নীতুর তিন বছরের ছোট। মইনুদিন চাচা বিয়ে করেন অনেক দেরিতে। নীতুর জন্মেরও বছরখানেক পর। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। হঠাৎ আসবেন তখন তাকে অন্য বাড়ির লোক মনে হত। তিনি থাকতেন চমৎকার বাংলো প্যাটার্নের একটা বাড়িতে। যে বাড়ির ভাড়া সাত হাজার টাকা। দারোয়ান আছে, মালি আছে। চারটা বাথরুমের তিনটাতেই বাথটাব। হুলস্থূল কাণ্ড। আমরা বেশ কয়েকবার ঐ বাড়িতে গিয়েছি, কখনো স্বস্তি বোধ করিনি। এই বাড়িতে গেলেই মনটা খারাপ হয়ে যেতো। ওরা এত বড়লোক, আমরা এত গরিব! মইনুদিন চাচা এক সময় দরিদ্র ছিলেন এবং বাবার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন– এটা বিশ্বাস করতেই আমার কষ্ট হত। বাবা যখন তাঁর সঙ্গে তুই তুই করে কথা বলতেন তখন আমার ভয় ভয় করত। মনে হত বাবা খুব একটা ভুল কাজ করছেন। এই ভুলের জন্য সবার সামনে বকা খাবেন।
তানিয়া এবং তার ছোট বোন মুনিয়াও বেশ কয়েকবার আমাদের বাসায় এসেছে। মেয়ে দুটির চেহারা ভালো না, তবে সব সময় সেজেগুজে থাকত বলে দেখতে ভালো লাগত। এই দুই মেয়ে আমাদের বাসায় এলে কখনো কথা বলত না। গম্ভীর মুখে বসে থাকত। নীতু একবার তানিয়াকে হাত ধরে তার ঘরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। তানিয়া বিরক্ত গলায় বলেছিল, প্লিজ, আমার হাত ধরে টানাটানি করবেন না। কেউ গায়ে হাত দিলে আমার ভালো লাগে না। এই কথায় নীতু খুবই অপমানিত বোধ করে। সে তখন ক্লাস টেনে পড়ে— অপমানিত বোধ করারই বয়স। সেই বছরই মইনুদিন চাচা ইংল্যান্ডে চলে যান এবং আমরা তাদের নতুন বাড়িতে কেয়ারটেকার হিসেবে উঠে আসি।
নীতু কিছুতেই এই বাড়িতে থাকতে রাজি ছিল না। বার বার ঘাড় গোজ করে বলছিল, আমরা কেন ওদের বাড়িতে থাকব? আমরা কি পাহারাদার যে উনার বাড়ি পাহারা দেব? আমি কিছুতেই ঐ বাড়িতে যাব না। মরে গেলেও না। ওটা তানিয়াদের বাড়ি। ঐ হিংসুটে মেয়ের বাড়িতে আমি থাকব না। না-না-না।
মজার ব্যাপার, মইনুদিন চাচার ঐ হিংসুটে মেয়ের চিঠি পড়ে আমাদের বাসায় শান্তি ফিরে এল। বাবার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে গেল। যদিও সেই চিঠি পড়ে বন্ধুর অসুখের কথা ভেবে তাঁর বিষাদগ্ৰস্ত হবার কথা ছিল। তিনি তেমন বিষাদগ্ৰস্ত হতে পারলেন না। তবু মুখ যথাসম্ভব করুণ করে বললেন, আহা, কী অসুখ হল বল তো? অসুখ সম্পর্কে যখন কিছু লেখে নি তখন তো মনে হচ্ছে মারাত্মক কিছু। ক্যানসার না তো? ক্যানসার হলে আমি তো কোনো আশা দেখি না। ভেরি স্যাড। ক্যানসার হ্যাজ নো আনসার।