সব ভাইবোন সম্পর্কেই বললাম, এবার বোধ হয় নিজের কথা কিছু বলা দরকার। মুশকিল হচ্ছে, আমার নিজের প্রসঙ্গে বলার মতো কিছু নেই। তাছাড়া বলতে ইচ্ছে করছে না। বরং মার কথা বলি।
মা এককালে খুব রূপবতী ছিলেন। তাঁর তরুণী বয়সের একটি ছবি আছে। সেই ছবির দিকে তাকালে হতভম্ব হয়ে যেতে হয়। আজকের মোটাসোটা, চুলপাকা মার সঙ্গে এ ছিপছিপে তরুণীর কোন মিল নেই। ছবিতে মার মুখে এক ধরনের দুষ্ট হাসি। চোখ দুটাকে অন্য ভুবনের রহস্যময়তা। একবার ছবির সামনে দাড়ালে চট করে সরে যাওয়া যায় না। খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে হয়। মা খুব রাগারগি করেন এটা তো বলেছি। তবে সবার সঙ্গে না। তাঁর রাগের মূল টার্গেট বুনোভাই। দ্বিতীয় টার্গেট নীতু। বড় ভাইয়ের উপর রাগ করার তা-ও একটা অর্থ হয়, নীতুর উপর রাগের আমি কোনো কারণ খুঁজে পাই না। অনেক মানুষের সামনে নীতুকে অপমান করতে পারলে তিনি যেন কেমন আনন্দ পান। আবার একই সঙ্গে নীতুর সামান্য অসুখ-বিসুখে অস্থির হয়ে যান। অবশ্যি বড় আপার সঙ্গে মার খুবই খাতির। দুজনে পান খেতে খেতে বান্ধবীর মতো গল্প করেন। গল্পের এক পর্যায়ে একজন অন্য জনের গায়ে ধাক্কা দেন। দেখতে খুব ভালো লাগে।
আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে কিছু বলা হল না। দোতলা বাড়ির কথা এক ফাঁকে বলেছি, নীতুর আলাদা ঘরের কথা বলেছি। এর থেকে ধারণা হওয়া বিচিত্র নয় যে, আমরা বেশ মালদার পার্টি। আসলে তা না। সাধু ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়–ইহা সত্য নহে। আমরা মোটেই মালদার পার্টি নই। খুবই দুর্বল পার্টি। আশেপাশে কেউ তা জানে না। তারা দেখে অনেকখানি জায়গা জুড়ে চমৎকার একটা দোতলা বাড়ি। লাল রঙের বাগানবিলাসের পাতা যখন বাড়িটা ঢেকে ফেলে তখন এই বাড়িকে স্বপ্নের বাড়ি বলে মনে হয়। এই বাড়িতে যারা থাকে তাদের দুর্বল পার্টি মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই।
কাউকে বাড়ির ঠিকানা দেবার সময় আমরা বলি, রাস্তার ডান দিক মোড় নিলেই দেখবেন চমৎকার, একটা শাদা বড়ি। বাগানবিলাসের ছাওয়া। আমাদের বাড়ির কথা বলতে গেলে চমৎকার বিশেষণ আপনা আপনি চলে আসে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে— এই বাড়ি কিন্তু আমাদের না। আমরা এই বাড়ির কেয়ারটেকার, আসল মালিক হলেন মইনুদিন চাচা— বাবার ছেলেবেলার বন্ধু। তারা দুজন একই সঙ্গে বি. এ. পাস করেন। বাবা ধরাধরি করে চাকরি পেয়ে যান, মইনুদ্দিন চাচা পান না। তিনি ইন্টারভ্যুর পর ইন্টারভ্যু দিতে থাকেন। তাঁর খুবই খারাপ সময় যেতে থাকে। বাবা তখন মোটামুটি সব গুছিয়ে ফেলেছেন। বিয়েও করেছেন। ফ্ল্যাটে ভাড়া করে থাকেন। গোছানো ছিমছাম সংসার।
মইনুদ্দিন চাচার কিছু হচ্ছে না। বাবার সঙ্গে থাকেন। বসার ঘরে সোফায় রাতে ঘুমান, সারাদিন চাকরির চেষ্টা করেন। কিছু হয় না। শেষে কী একটা ব্যবসা শুরু করলেন। ব্যবসা ঠিক না। দালালি ধরনের কাজ, যাতে ক্যাপিটেল লাগে না। এতেই তাঁর কপাল খুলে গেল। হু-হু করে পয়সা আসতে লাগল। দালালি ছেড়ে নানান ধরনের ব্যবসা শুরু করলেন। কয়েটা মার খেল। কয়েকটা দাড়িয়ে গেল। বাড়ি করলেন। তারপর চলে গেলেন ইংল্যান্ড। ঐখানে ব্যবসার চেষ্টা দেখবেন, তাছাড়া দেশে বোধহয় ব্যবসা-সংক্রান্ত তার কিছু জটিলতাও সৃষ্টি হয়েছে। বাড়ি চলে এল আমাদের হাতে। ঠিক হল আমরা থাকব, বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ করব।
বাবা বললেন, এক শর্তে থাকব–ভাড়া নিতে হবে। যত ভাড়া হওয়া উচিত তা তো দিতে পারব না। যা পারি আলাদা একাউন্ট করে জমা রাখব।
মইনুদিন চাচা বললেন, বেশ। কিছু কিছু টাকা আলাদা একাউন্টে রাখ। ছোটখাটো রিপিয়ারিঙের কাজ এই টাকায় করা যাবে। আমার কোনো আপত্তি নেই। বাড়ি আমি অন্যের হাতে দিতে চাই না। বাড়ির পেছনে তোমরা খরচপাতি করতে চাও করবে।
আমরা কোনো খরচপাতিই করলাম না। মইনুদিন চাচার একাউন্টে এক পয়সাও জমা পড়ল না। আমরা অন্যের বাড়িতে দিব্যি থাকি। খাই, দাই, ঘুমাই। প্রতি মাসে বাড়িভাড়ার টাকাটা বেঁচে যায়।
শুধু তাই না, বাবা চিঠি লিখে মইনুদিন চাচার কাছ থেকে মাঝে মাঝে টাকা আনান। যেমন একবার লিখলেন–দোতালার ছাদে দুটা ঘর করে রাখলে বেশ ভালো হয় এবং ছাদের চারদিকে রেলিং দেয়া দরকার। বাচ্চারা ছাদে যায়। মুইনুদ্দিন চাচা তার জন্যে আলাদা করে টাকা পাঠালেন। পানির পাম্পের জন্যে লেখা হল। তার জন্যেও টাকা চলে এল। কিছু মাটি দিয়ে উঠোনটা উঁচু করা দরকার। ছয় ট্রাক মাটি হলেই চলে। মইনুদিন চাচা সেই টাকাও পাঠান। এসব টাকার কোনোটাই বাবা কাজে লাগালেন না। ঘর উঠল না। রেলিং হল না। পানির পাম্প কেনা হল না। মইনুদিন চাচা বাড়ির পেছনে দুটা ঘর করার জন্যেও টাকা পাঠালেন। ঐ ঘরে ড্রাইভার, মালী, দারোয়ান ওরা থাকবে। তিনি এই সঙ্গে ইংরেজিতে একটি চিঠি লিখেন যার বিষয়বস্তু আগামী বছরে মাঝামাঝি তিনি দেশে আসবেন। কতদূর কী হল দেখবেন। অথচ কিছুই করা হয় নি। শেষবার পাঠানো টাকা বাবা একটা ব্যবসায় খাটিয়েছিলেন। সেখান থেকে আর পয়সা আসে নি। আমিও গেছে, ছালাও গেছে।
এখন বাবার মানসিক অবস্থা খুবই খারাপ। আগে স্বাস্থ্যবিধি পালনে নিয়মিত প্ৰাতঃভ্রমণ করতেন, সেই প্ৰাতঃভ্রমণ আপাতত বন্ধ। অফিস থেকে এসে ঝিম মেরে বসে থাকেন। কলিংবেল বাজলে দারুণ চমকে ওঠেন। বোধহয় ভাবেন–মইনুদিন চাচা চলে এসেছেন। যখন দেখা যায়, না মইনুদিন চাচা না অন্য কেউ, তখন বাবার চোখে আনন্দের একটা আভা খেলে যায়। আমার বড় মায়া লাগে। কয়েক দিন আগে সবাইকে ডেকে একটা মিটিঙয়ের মতো করলেন, শুকনো মুখে বললেন, মইনুদিন চলে আসছে। একটা কিছু তো করতে হয়। বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। কম ভাড়ায় একটা বাসা খোজা দরকার। তোমাদের বিষয়টা বলতে আমি কোনো অসুবিধা দেখছি না। বলাই উচিত—আমি এখন চোখে অন্ধকার দেখছি। Total darkness.