কেন সেটা তো তুই বলবি। তোর কাছে থেকেই শুনতে চাই। খানিকক্ষণ আগে রিমি কী করছিল? বল, কী করছিল?
চিৎকার করছিল।
বাচ্চারা চিৎকার করবে না?
করবে। তবে সারাক্ষণ করবে না এবং চিৎকার থামতে বললে থামবে। এদের মুখে কোন ব্ৰেক নেই।
সে চিৎকার করছিল শুধু এই কারণে তুই তাকে চড় দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিবি? আচ্ছা একটা মেয়ে!
আমি স্তম্ভিত হয়ে বললাম, কী বলছ আপা? চড় দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেব কেন?
আবার অস্বীকার করছিস? তোর লজ্জাও লাগে না? কয়েকটা দিন শুধু আছি তাও সহ্য হচ্ছে না? আমরা কি জন্মের মতো তোদের ঘাড়ে এসে চেপেছি? আমরা কি সিন্দাবাদের ভূত যে নামাতে পারবি না? আর আমাদের যদি তোর এতই অসহ্য হয় সেটা বলে ফেল–চলে যাই। এমন তো না যে যাবার জায়গা নেই। ফ্ল্যাটে তালা দিয়ে এসেছি— তালা খুলে ঢুকব।
আপা, ব্যাপারটা হচ্ছে কী…
থাক, তোকে ব্যাপার বলতে হবে না। ব্যাপার। আমি বুঝতে পারি। আমার কি চোখ নেই? আমার চোখ আছে। দুই-এ দুই-এ যে চার হয় তা-ও আমি জানি। তোরা কেউ এখন আমাদের সহ্য করতে পারছিস না। বাবা সেদিন পলিকে ধমক দিলেন। আমার সামনেই দিলেন। আমি তো হতভম্ব। আমার সামনে আমার মেয়েকে ধমক দেবেন। কেন?
বড় আপা চোখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুপাতে লাগলেন। তাঁকে নিয়ে বড় যন্ত্রণা হচ্ছে। তাঁর মনে একটা ধারণা ঢুকে গেছে যে এ বাড়িতে আমরা তাকে পদে পদে অপমান করছি। অপদস্থ করার চেষ্টা করছি।
একই মায়ের পেট থেকে আমরা পাঁচ ভাইবোন এসেছি। পাঁচজনই সম্পূর্ণ পাঁচ রকম। বড় আপা অসম্ভব সন্দেহপরায়ণ, ঝগড়াটে এবং ছিচকাদুনে। বুনোভাই চুপচাপ ধরনের। কোনো কিছুতেই তিনি রাগ করেন না। এম.এ. পাস করেছেন চার বছর আগে। এই চার বছরে চাকরির কোনো চেষ্টা করেন নি। আমাদের দূর সম্পর্কের একজন আত্মীয় আছেন— শিল্পমন্ত্রী। তাঁকে ধরাধরি করে নারায়ণগঞ্জের একটা মিলে তার জন্য চাকরি যোগাড় করা হল। ভালো চাকরি, ছ হাজার টাকার মতন বেতন। কোয়ার্টার আছে। দেড় মাস সেই চাকরি করে একদিন সুটকেস নিয়ে বাসায় চলে এলেন। এই চাকরি নাকি ভালো লাগে না। তাকে ফেরত পাঠানোর জন্য অনেক টেলাঠেলি করা হল। কোনোই লাভ হল না। মা যত রাগ করেন বুনোভাই তাত হাসেন। বড়দের কোনো ছেলেমানুষি দেখে আমরা যেমন হাসি সে রকম হাসি। মা রাগী গলায় বললেন, এই চাকরি তোর পছন্দ না। কী চাকরি তোর পছন্দ?
কোনো চাকরিই পছন্দ না, মা!
কী করবি তাহলে?
কিছুদিন রেস্ট নেব।
রেস্ট নিবি মানে? রেষ্ট নিবি–এর মানে কী?
রেস্ট নেবার মানে হচ্ছে বিশ্রাম করা। কিছুদিন বিশ্রাম করব বলে ঠিক করেছি, মা।
বিশ্রাম করবি?
হ্যাঁ। শুয়ে-টুয়ে থাকব। বই-টই পড়ব।
সত্যি সত্যি বুনোভাই পরের এক মাস শুয়ে শুয়েই কাটালেন। হাতে একটা পত্রিকা কিংবা বই। সেই বই মুখের উপর ধরা। পা নাচাচ্ছেন। মুখ হাসি হাসি। যেন তিনি বড় আনন্দে আছেন। রিমি এবং পলি বেশির ভাগ সময় তার ঘরেই লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপি করেন। তিনি ফিরেও তাকান না। তাদের চিৎকার, চেঁচামেচি তাঁর কানে ঢোকে বলেও মনে হয় না। সেই তুলনায় আমার মেজোভাই খুব প্র্যাকটিক্যাল। মেজোভাই ইনজিনিয়ারিং পড়েন–ফাইন্যাল ইয়ার। রাতদিন পড়াশোনা নিয়ে আছেন।
পাস করার সঙ্গে সঙ্গে যাতে বাইরে যেতে পারেন। সেই চেষ্টাও আছে। নানান জায়গায় লেখালেখি করছেন। একটা মেয়ের সঙ্গে তার বেশ ভালো ভাব আছে। খুব বড়লোকের মেয়ে। গাড়ি করে এ বাড়িতে আসে। এই গাড়িও মেয়ে নিজেই চালায়। মেয়েটার নাম শ্রাবণী। মেজোভাই ডাকেন বনী বলে। খুব মিষ্টি করে ডাকেন। কাউকে যে এত মিষ্টি করে ডাকা যায় তা আমার ধারণায় ছিল না। মেয়েটা দেখতে বিশেষ ভালো না। চেহারায় কেমন পুরুষ পুরুষ ভাব। এই মেয়ে ছাড়াও আরো একটি মেয়ে মেজোভাইয়ের কাছে আসে। সেই মেয়েটা দেখতে খুবই সুন্দর। তবে গরিব ঘরের মেয়ে। বেশির ভাগ সময়ই সে হেঁটে হেঁটে আসে। তার নাম শোভা। মেজোভাই তাকে ডাকেন শু বলে। এই মেয়ে বাসায় এলে মেজোভাইয়ের মুখ অস্বাভাবিক উজ্জ্বল দেখায়। মেয়েটি চলে যাবার সময় মেজোভাই তাকে এগিয়ে দেবার জন্য অনেক দূর যান। হয়তো বাসে তুলে দেন। কিংবা রিকশা ঠিক করে দেন। মেজোভাইয়ের মুখের উজ্জ্বল ভাব মেয়েটি চলে যাবার পরেও অনেকক্ষণ থাকে। তবু আমার কেন জানি মনে হয় মেজোভাই বড়লোকে মেয়েটাকেই বিয়ে করবেন। কারণ খাবার টেবিলে একদিন কথায় কথায় বললেন, বাংলাদেশের কিছু কিছু মানুষের অসম্ভব পয়সা হয়েছে। শ্রাবণী বলে যে একটা মেয়ে আমার কাছে আসে ওরা তিন বোন। তিনজনের নামেই গুলশানে আলাদা আলাদা বাড়ি আছে। তিনজনের আলাদা আলাদা গাড়ি। Can you belive it? কথাগুলো বলার সময় মেজোভাইয়ের মুখ ঝলমল করতে লাগল। চোখে ঘোর ঘোর ভাব চলে এল। মনে হল তিনি কল্পনায় গুলশানের বাড়ি এবং বাড়ির সামনে কালো রঙের মরিস মাইনর গাড়িটা দেখতে পাচ্ছেন।
আমার সবচে ছোট বোনের নাম নীতু। নীতু এবার ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার কারণেই বোধহয় নিজেকে সে বেশ বড় বড় ভাবছে। যদিও সে এখনো পুরোপুরি ছেলেমানুষ। বাসায় সারাক্ষণ আচার খায়। শিবরামের বই পড়ে হি হি করে হাসে। টিভির অতি অখাদ্য নাটকও গভীর আগ্রহে দেখে। করুণ রসের দুএকটা ডায়ালগ শুনলেই তার চোখে ছিল ছল করে ওঠে। ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে সে নিজের জন্য একটা ঘর নিয়েছে। প্রতিরাতেই নিজের ঘরে ঘুমুতে যায়। একবার ঘুম ভাঙলেই ভয় পেয়ে মার ঘরে চলে আসে। ছোটবেলায় নীতুকে রাগানোর একটা বুদ্ধি ছিল। তার সামনে দড়িয়ে বলা–নীতু, আয় তু-তু-তু। নীতুর স্কুল জীবনের বন্ধুরা এখনো তাকে এভাবে ক্ষেপায়। নীতু হচ্ছে আমাদের পরিবারের সবার আদরের মেয়ে এবং হয়তোবা সবচে ভালো মেয়ে। উঁহু, ঠিক হল না। সবচে ভলো আমাদের বুনোভাই। মা যাকে অজগর সাপ বলেন।