আমি যে আজ ছাদে এসেছি তার কারণ একটিই–মার সঙ্গে নিরিবিলিতে কিছুক্ষণ কথা বলতে চাই। মা এখনো আসছেন না। হয়তো বেছ বেছে আজই তিনি আসবেন না। মার সঙ্গে নিরিবিলি কথা বলা কোনো সমস্যা নয়। তার ঘরে প্রায় সময়ই কেউ থাকে না। কিন্তু আমি অন্য ধরনের নিরিবিলি চাচ্ছিলাম।
সন্ধ্যা মিলিয়ে অন্ধকার হয়ে গেল। আকাশে মেঘ জমছে। আবার বৃষ্টি শুরু হবে।
আমি সিড়ি দিয়ে নামছি। তখনই মার সঙ্গে দেখা হল। তিনি আমাকে দেখে অসম্ভব চমকে উঠলেন। যেন ভূত দেখেছেন।
আমি বললাম, কেমন আছ, মা?
মা বললেন, ও তুই? চমকে উঠেছিলাম।
কী ভেবেছিলে, ভূত?
মা আর জবাব না দিয়ে বললেন, তুই কি প্রায়ই ছাদে আসিস?
না। আজ এসেছিলাম।
বৃষ্টি-বাদলার সময় আসবি না। পিছল ছাদ। একটা অঘটন ঘটতে কতক্ষণ?
তুমি তো প্রায়ই আস।
আমার কথা বাদ দে।
মা আমাকে পাশ কাটিয়ে উপরে উঠতে যাচ্ছেন। তখন হঠাৎ বললাম, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম।
কী কথা?
বাড়ির প্রসঙ্গে একটা কথা। বুনোভাই আমাকে বলেছেন। তিনি শুনেছেন বাবার কাছে। কথাটি সত্যি কিনা আমি জানতে চাই।
মা কিছু বলতেন না। আমাকে পাশ কাটিয়ে ছাদে উঠে গেলেন। আর তখন বৃষ্টি নামল। আমি দেখলাম, মা ছাদের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন। সাদা চাদর গায়ে দিয়ে এসেছিলেন। সেই চাদরে তিনি মাথা ঢেকে দিলেন।
আমি মার কাছে এগিয়ে গেলাম। কোমল গলায় বললাম, বৃষ্টিতে ভিজছ কেন মা? চল ঘরে যাই।
তুই যা।
মা গলার স্বর কঠিন এবং কান্না-ভেজা। আমি চলে এলাম। বুনোভাইয়ের ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় দেখি–বুনোভাইয়ের খাটে বাবা জবুথুবু হয়ে বসে আছেন। বাবার পিঠে হাত রেখে বুনোভাইও বসে আছেন। আমি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাসিমুখ বললাম, কেমন আছ বাবা?
তিনি অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, জ্বি, ভালো আছি। আপনার শরীর ভালো?
বাবা আমাকে চিনতে পারেন নি। ইদানীং কাউকেই প্ৰথম দর্শনে বাবা চিনতে পারেন না।
আমি বললাম, এখানে কী করছ, বাবা?
ও আচ্ছা, তুই! রঞ্জ। অন্ধকারে চিনতে পারি নি। বাইরে কি বৃষ্টি হচ্ছে?
হুঁ।
ভালো, ভালো। বৃষ্টি হওয়া ভালো।
এখানে কী করছেন?
বুনোর সঙ্গে গল্প করছি। আয়, তুইও আয়।
আমি বাবার পাশে বসলাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে অল্প হাসলেন। সেই হাসিতে স্নেহ ছিল, প্রশ্রয় ছিল। বাবা নরম স্বরে বললেন, রঞ্জু, বাড়িটা নিয়ে সমস্যায় পড়েছি।
সমস্যার কী আছে, বাবা?
আছে, সমস্যা আছে। জটিল সমস্যা। তুই ছেলেমানুষ, সমস্যা বুঝবি না। জানালা দিয়ে দেখ তো বৃষ্টি এখনো হচ্ছে কিনা।
জানালা দিয়ে দেখার কিছু নেই। বুম বৃষ্টি হচ্ছে। মা কি এখনো ছাদে দাড়িয়ে ভিজছেন?
ঘটাং ঘটাং শব্দে ঘুম ভাঙল
ঘটাং ঘটাং শব্দে ঘুম ভাঙল।
একেবারে কাকডাকা ভোর। এত ভোরে জিতু মিয়া পানি তোলা শুরু করেছে?
কাকদের ঘুমও তো ভালো করে ভাঙে নি। আমি বিস্মিত হয়ে বারান্দায় এসে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম— বাবা টিউবওলের পাম্প চালাচ্ছেন। তাঁকে বিরত করার চেষ্ট করছে নীতু এবং বড় আপা। মাও আছেন। তিনি দূরে দাঁড়িয়ে আছেন, কিছু বলছেন না। নীতু তীক্ষ্ণ গলায় বলল,বাবা তুমি কাউকে না ধরে দোতলায় উঠাতে পার না— আর তুমি পানি তুলছ? বাবা গম্ভীর গলায় বললেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা দরকার। না মানার জন্য মইনুদিনের অবস্থা তো দেখলি। ফট করে চলে গেল। সে বয়সে আমার এক বছরের ছোট।
বাবা প্লিজ, বন্ধ কর। প্লিজ।
নীতু বাবাকে এসে প্রায় জড়িয়ে ধরল। বড় আপা বাবার কানে কানে কীসব যেন বলছেন। বাবা তার উত্তরে শুধু মাথা নাড়াচ্ছেন।
মেজোভাইও ঘুম ভেঙে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর দৃষ্টি তীক্ষ্ম। মুখ কঠিন।
মেজোভাই আমার দিকে ফিরে বললেন, বড় আপা বাবাকে কী বলছে?
আমি বললাম, বুঝতে পারছি না।
বাড়ি নিয়ে কিছু বলছে বোধহয়।
মনে হয় না।
তাই বলছে। এরা দুজন ক্রমাগত বাবাকে জাপাচ্ছে— বাড়ি ছেড়ে দাও। বাড়ি ছেড়ে দাও। মেয়েদের বুদ্ধি। ইডিয়টস।
মেজোভাই থু করে থুতু ফেললেন। কদিন ধরেই দেখছি তার থুতু ফেলার রোগ হয়েছে। গৰ্ভবতী মেয়েদের মতো ক্রমাগত থুতু ফেলেন। থুতু ফেলার সময় তার মুখ ঘৃণায় কুঁচকে যায়। কার উপর এত ঘৃণা কে জানে?
রঞ্জু!
বল।
ওরা দুজন ক্রমাগত বাবাকে জপাচ্ছে। ক্রমাগত জপাচ্ছে।
না, উনার শরীর খারাপ, তাই সারক্ষণ পাশে পাশে থাকে।
আমরা সারা জীবন কষ্ট করেছি। এখন একটা সুযোগ পাওয়া গেছে–এরা সবাই সুযোগ নিতে দেবে না। ইনজিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার সময় সাতশ টাকা লাগে। সেই টাকা কীভাবে যোগাড় করেছিলাম জানিস?
না।
শোভাকে বলেছিলাম। সেই বেচারি তার কানের দুল বিক্রি করে টাকা দিয়েছিল। ওদের বাড়িতে জানাজানি হয়ে যেতে একটা বিশ্ৰী কাণ্ড হয়।
তুমি তার জন্মদিনে যাও নি কেন?
তোকে কে বলল?
আমি আমার এক ফ্রেন্ডের কাছে শুনেছি। অনেক রাত পর্যন্ত বেচারি তোমার জন্য অপেক্ষা করেছিল। কাজটা ভালো কর নি।
মনে ছিল না। খুব আপসেটিং লাগছিল–মানে এখনো লাগছে। আচ্ছা, ও কি এর মধ্যে এসেছিল?
আমি মিথ্যা করে বললাম, একদিন এসেছিলেন। গেট দিয়ে ঢুকে তারপর হঠাৎ দেখি বের হয়ে চলে যাচ্ছেন।
তাই নাকি?
মেজোভাইয়ের চোখ করুণ হয়ে গেল। আমি বললাম, তুমি আজ তাদের বাসা থেকে ঘুরে আস না কেন?
যাব। দু-একদিনের মধ্যেই যাব। যেতে ইচ্ছে করে না। মেজাজ এমন খারাপ হয়েছে! সবার সাথে শুধু ঝগড়া করতে ইচ্ছে করে। এখন মনে হচ্ছে বুনোভাই সুখে আছে। দিনরাত শুয়ে বসে. ছিঃ ছিঃ। যে ফ্যামিলির সবচে বড় ছেলের এই অবস্থা সেই ফ্যামিলি এমন একটা সুযোগ কি ছাড়তে পারে? পারা কি উচিত? তোর কী মনে হয়, উচিত?