ভাইয়া, তোমার এক নম্বর বান্ধবীর সঙ্গে আজ দেখা— শ্ৰাবণী। ফুটপাতের কাছে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ফুটপাতের দোকানগুলোতে ছিট কাপড় দেখছিল।
তাই নাকি?
আমার একটা অবজারভেশন কি জানি ভাইয়া? আমার অবজারভেশন হচ্ছে ফুটপাতে সবচে বেশি ঘোরাঘুরি করে বড়লোকেরা। এটা এদের এক ধরনের ফ্যাশন।
হতে পারে।
আমি উনাকে বললাম, কী, ভালো আছেন? মনে হল চিনতে পারল না। বড়লোকদের স্মৃতিশক্তি খুব দুর্বল হয়। ইস, কী কুৎসিত রং হয়েছে তরকারিটার! মনে হচ্ছে রেড পেইন্ট খাচ্ছি।
মেজোভাই চোখের ইশারায় নীতুকে থামিয়ে দিলেন। ভাগ্যিস, বড় আপা সামনে নেই। নীতু নিচু গলায় বলল, ভাইয়া, তোমরা এই তরকারি খাচ্ছ কী করে? লবণ তো একেবারেই নেই।
চুপ করে খা।
নীতু মুখ বেজার করে খেতে শুরু করল। মেজোভাই বললেন, একটা খবর দিয়ে তোদের আজ চমৎকৃত করে দিতে পারি।
নীতু বলল, কোনো খবরেই আমি চমৎকৃত হব না।
এটা শুনলে চমকে যাবি। আমি তানিয়াদের বাসায় গিয়েছিলাম। নীতু সত্যি সত্যি চমকাল। মেজোভাই বললেন, কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে যাই নি, জাস্ট সােস্যাল ভিজিট। ঠিকানাটা ছিল। ঐদিকে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম …নীতু হেসে ফেলল।
মেজোভাই বলল, হাসলি যে?
অন্য অথা ভেবে হেসেছি। তোমার সোস্যাল ভিজিটের সাথে আমার হাসির কোনো সম্পর্ক নেই। তানিয়ার সঙ্গে তোমার কথা হয়েছে?
হ্যাঁ।
কী কথা জানতে পারি?
তেমন স্পেসিফিক কোনো কথা না–তবে যা বুঝতে পারলাম, তা হচ্ছে এই মেয়ের প্রচুর টাকা। বুনোভাই বলছিল, এদের হাতে টাকা-পয়সা নেই। যা ছিল বাপের চিকিৎসায় সব শেষ হয়েছে। এটা ঠিক না। এই বাড়ি ছাড়াও তাদের আরো একটা বাড়ি আছে–গুলশানে। সেই বাড়ি থেকে ভাড়াই আসে মাসে ত্ৰিশ হাজার।
ভালো কথা।
আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হচ্ছে–বুনোভাইয়ের ধারণা ঠিক না। বুনোভাইয়ের ধারণা— এই বাড়ি মেয়েটা তার বাবার শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য দিয়েছে এবং দিয়ে কষ্টে পড়েছে। দ্যাটস নট ট্রু।
তোমার কি ধারণা মইনুদিন চাচা আমাদের উপহার দেবার জন্যে এ বাড়ি বানিয়েছিলেন?
হতে পারে। সম্ভাবনা উড়িয়ে দেবার মতো না। বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু দীর্ঘদিন আমাদের বাড়িতেই ছিলেন। এই সব কথা মনে করে…।
নীতু হাসল। হাসতে হাসতে বলল— বাড়ি বাড়ি করে তোমার মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
মাথা এলোমেলো হবে কেন? পুরো ব্যাপারটা অ্যানালিসিস করছি।
তানিয়া কি তোমাকে চা-টা খাওয়াল?
খাওয়াবে না কেন? চমৎকার মেয়ে। এ দেশে থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। গুলশানের বাড়ি বিক্রি করার কথা বলছিল, তার থেকে মনে করছি দেশে থাকবে না। ভদ্রলোকরা আজকাল আর দেশে থাকে না। আমি অবশ্যি সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করি নি।
তুমি এক কাজ কর ভাইয়া, শ্রাবণীর পেছনে পেছনে না ঘুরে এই মেয়ের সঙ্গে ভাব কর।
মেজোভাই রাগী গলায় বললেন, ফাজলামি করছিস নাকি? নীতু হাসিমুখে বলল, হ্যাঁ ফাজলামি করছি। চট করে রেগে যাবার মতো কিছু অবশ্যি করি নি। আর তুমি যদি রেগে যাও সেটাও তোমার জন্য খারাপ হবে। আমি এমন সব কথা বলব যে সহ্য করতে পারবে না। আমি যেমন ফাজলামি করতে পারি, তেমনি কঠিন কথাও বলতে পারি।
আমি খাওয়া শেষ করে উঠে পড়লাম। তারা দুজনে দুজনের দিকে তীব্ৰ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কেউ দৃষ্টি নামিয়ে নিচ্ছে না। এ যেন চেয়ে থাকার একটা প্ৰতিযোগিতা। যে প্রথম চোখ নামিয়ে নেবে সে হেরে যাবে। মেজোভাই হেরে গেলেন। তিনিই প্রথম চোখ নামিয়ে নিলেন। নীতু বিজয়ীর ভঙ্গিতে বসে আছে।
মেজোভাইয়ের বান্ধবী
মেজোভাইয়ের এই বান্ধবীর সঙ্গে আমার আগে কখনো কথা হয় নি। আজ কথা হল। সন্ধ্যার আগে আগে তিনি বাসায় এলেন। আমি দোতলা থেকে দেখলাম। বেচারিকে খুব কুক্কান্ত মনে হচ্ছিল। মনে হয় অনেক দূর থেকে হেঁটে হেঁটে এসেছে। দুপুরে খাওয়া হয় নি।
জিতু মিয়া আমাকে এসে বলল, আপনেরে ডাকে।
আমাকে ডাকবে কেন? আমাকে ডাকে না। ভাইয়াকে ডাকে। তুই গিয়ে বল উনি নেই।
বলছি, আফা আপনের সাথে কথা বলতে চায়।
মেয়েটি জড়োসড়ো হয়ে বসার ঘরে বসেছিল। আমাকে দেখে আরো যেন জড়োসড়ো হয় গেল। তার পরনে হালকা সবুজ রঙের শাড়ি। সবুজ শাড়িতে মেয়েদের খুব মানায় অথচ এই রঙটা কেন জানি মেয়েরা পছন্দ করে না।
আপনি কি আমাকে ডেকেছেন?
জ্বি।
কী ব্যাপার বলুন তো?
আমার সঙ্গে একটু বাইরে আসুন। প্লিজ।
আমি বিস্মিত হয়ে তার সঙ্গে এগিয়ে গেলাম। আমাকে সে একেবারে রাস্তায় নিয়ে এসে নিচু স্বরে বলল, আমি যে এসেছি। এটা যেন ও না জানে।
কেউ জানবে না। অবশ্যি এখন যদি ভাইয়া চলে আসেন তাহলে ভিন্ন কথা। সম্ভবত আসবেন না। কয়েকদিন ধরেই রাত আটটা সাড়ে আটটার দিকে আসেছেন। ব্যাপারটা কী বলুন তো?
পরীক্ষা দিচ্ছে না কেন জানেন?
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, পরীক্ষা দিচ্ছে না! কী বলছেন এসব?
না, দিচ্ছে না। শুধু প্ৰথম পরীক্ষাটায় বসেছিল। তারপর আর বসে নি।
সে কী!
আমার বড়ভাই ওর সঙ্গে পড়ে। তার কাছ থেকে শুনেছি। আমি ওকে জিজ্ঞেস করায় খুব রাগারগি করল। আমার সঙ্গে সে কখনো রাগারগি করে না। আমার এত মনটা খারাপ হয়েছে!
মেয়েটির চোখে সম্ভবত পানি এসে গেছে। সে আমার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। বেচারি চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করছে। আমি বললাম, ভাইয়া পরীক্ষা দিচ্ছে না, আমরা এটা জানতাম না। আমরা জানতাম, সে ঠিকমতোই পরীক্ষা দিচ্ছে। আপনি কি আরো কিছু বলবেন?