বাবা আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। পারিবারিক জরুরি মিটিং না বলে মনে হচ্ছে। পারিবারিক মিটিংয়ে ভাইয়া উপস্থিত থাকত। তাকে ডাকা হয়নি। এমনও হতে পারে যে বাবা তাকে পরিবার থেকে বের করে দিয়েছেন।
বাবা বললেন, পদ্মর মা একটা নতুন ফ্রিজ কিনেছেন বলে শুনলাম।
আমি বললাম, হুঁ। আট সিএফটির ফ্রিজ। লাল রং। স্যামসাং কোম্পানি।
এত বিস্তারিত শুনতে চাচ্ছি না। অল্প কথায় মনের ভাব প্রকাশে অভ্যাস করো। হড়বড় করে দুনিয়ার কথা বলার কিছু নেই।
জি, আচ্ছা।
ওই মহিলা কি স্থায়ীভাবে থাকার পরিকল্পনা করছে?
জি। তাদের আলাদা কাজের মেয়ে চলে এসেছে। নাম মরি। মরিয়ম থেকে মরি। শুনেছি তাদের আলাদা রান্নাঘরও হবে।
তোমার কি মনে হয় না যে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন?
কী ব্যবস্থা?
ব্যবস্থা একটাই—ঘাড় ধরে মা-মেয়েকে বের করে দেওয়া। তবে আমরা সিভিল সোসাইটিতে বাস করি। ইচ্ছা থাকলেও অনেক কিছু করা সম্ভব না।
আমি বললাম, সম্ভব হলেও করা ঠিক হবে না। পদ্মর মায়ের কাছে নীল রঙের বোতলে ভর্তি এসিড আছে। এসিড ছুড়ে একটা কাণ্ড করে বসতে পারেন।
এসিডভর্তি বোতল?
জি, বাবা।
বাবা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, তোমার ভাইয়াকে বলো একটা ব্যবস্থা করতে। যে কাঁটা বিঁধিয়েছে, তারই দায়িত্ব কাঁটা বের করা। তোমার ভাইকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছিলাম। সে যাচ্ছে না কেন?
অমাবস্যার জন্যে অপেক্ষা করছে। প্রথম অমাবস্যাতেই ঘর ছাড়বে। গৌতম বুদ্ধ পূর্ণিমাতে গৃহত্যাগ করেছিলেন, ভাইয়া করবে অমাবস্যায়। উনি নতুন এক ধর্ম প্রচার করবেন। ধর্মের নাম রগট ধর্ম। তিনটি মূলনীতির ওপর এই ধর্ম দাঁড়িয়ে আছে। নীতিগুলো বলব, বাবা?
বাবা অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। বাবার চোখের ভাষাও আমি পড়তে পারছি না।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২৭, ২০১১
আমরা কেউ বাসায় নেই – ০৫
৫
ট্রাকড্রাইভার এবং ট্রাকচালক সমিতির পিআরও সালামত এসেছে ভাইয়ার কাছে। সালামত লম্বা, চেহারায় ইঁদুরভাব প্রবল। চোখ কোটর থেকে খানিকটা বের হয়ে আছে। লম্বা নাক, নাকের নিচে পুরুষ্ট গোঁফ। গায়ের রং কোনো একসময় হয়তো ফরসা ছিল। ময়লা জমে কিংবা রোদে পুড়ে কালচে ভাব ধরেছে। তাকে ঘিরে সস্তা সিগারেটের গন্ধের সঙ্গে মিলেছে জর্দার কড়া গন্ধ। তবে এখন সে পান খাচ্ছে না।
আমি বসেছি ভাইয়ার ঘরের বারান্দায়। ভাইয়াকে দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু সালামতকে দেখতে পাচ্ছি না। ভাইয়া বলল, আপনি ট্রাক চালান? আপনি তো ভাগ্যবান মানুষ।
এটা কেন বললেন?
বাংলাদেশের সব ট্রাকচালকের বেহেশত নসিব হবে, এই জন্যে বললাম।
কী বলেন এই সব?
ছুটন্ত ট্রাক দেখলেই আশপাশের সবাই আল্লাহর নাম নেয়। আপনাদের কারণে এত লোকজন আল্লাহর নাম নিচ্ছে, এই জন্যে আপনারা সরাসরি বেহেশতে যাবেন।
এই সব বাদ দেন। আমি আপনার কাছে কী জন্যে এসেছি সেটা শোনেন। উপায় না দেখে এসেছি।
বলুন, কী ব্যাপার।
পদ্ম মেয়েটার সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করে দেন। এটা আমার রিকোয়েস্ট। তার সঙ্গে আমার বিবাহ হয়েছে। একজনের বিবাহিত স্ত্রীকে আপনারা উঠায়ে নিয়ে এসেছেন, এটা কেমন কথা? আপনার স্ত্রীকে কেউ উঠায়ে নিয়ে গেলে আপনি কী করতেন?
ভাইয়া বলল, আমার স্ত্রীকে কেউ উঠায়ে নিয়ে যায় নাই, কাজেই কী করতাম বলতে পারছি না।
ভাইসাহেব, আমি ট্রাক নিয়ে এসেছি। পদ্মকে ডেকে দিন। আমি তাকে নিয়ে চলে যাব। কী ঘটেছিল তা নিয়ে মাথা ঘামাব না।
পদ্ম কি যাবে আপনার সঙ্গে?
অবশ্যই যাবে। তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন। এটা আপনার কাছে রিকোয়েস্ট। রিকোয়েস্ট না শুনলে অন্য পথ ধরব। সেটা আপনার ভালো লাগবে না।
ভাইয়া পদ্মকে ডেকে পাঠালেন। পদ্ম এসে দাঁড়াল। আমি বারান্দা থেকে পদ্মকে দেখতে পাচ্ছি না। দেয়ালে পদ্মর ছায়া পড়েছে। সেই ছায়া দেখতে পাচ্ছি।
ভাইয়া বলল, পদ্ম! ট্রাকড্রাইভার সালামত তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছে। ট্রাক নিয়ে এসেছে। তুমি কি তার সঙ্গে যাবে?
পদ্ম মিষ্টি করে বলল, যাব। কেন যাব না!
সালামত বলল, আমার স্ত্রীর নিজের মুখের কথা শুনলেন। এই কথার পর আর বিবেচনা নাই। পদ্ম, যাও, তৈয়ার হয়ে আসো। দশ মিনিট সময়।
পদ্ম বলল, এখন তো যেতে পারব না। পায়ে ব্যথা পেয়েছি। হাঁটতে পারি না। পায়ের ওপর দিয়ে রিকশা চলে গিয়েছিল। তুমি দেখো, পা ফুলে কী হয়েছে! পায়ের ফোলা কমুক। দশ দিন পরে আসো। এর মধ্যে পা ভালো হয়ে যাবে। আমি তোমার সঙ্গে চলে যাব।
সালামত বলল, পদ্ম, আমার কথা শোনো।
পদ্ম বলল, দশ দিন পরে তোমার কথা শুনব। এখন শুনব না।
পদ্ম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বের হয়ে গেল। ভাইয়া বলল, দশ দিন পর আসুন, দেখি কী হয়।
সালামত হতাশ গলায় বলল, দশ দিন পরেও কিছু হবে না। এই মেয়েকে আর মেয়ের মাকে আমি হাড়ে-গোশতে চিনি। ভাইসাহেব, শুনেন। এই মেয়ের পড়াশোনার খরচ, হাতখরচ—সব আমি দিয়েছি। মা-মেয়ের মাসখোরাকি খরচ দিয়েছি। আমার টাকায় মেয়ে বিএ পাস দিয়েছে। যখন বিয়ের কথা বলাম তখন পদ্ম বলল, ‘আপনার স্ত্রী আছে, আমি তো সতিনের ঘর করব না। স্ত্রীকে তালাক দিয়ে আসেন। তারপর বিবেচনা করব।’ জোবেদারে তালাক দিলাম। জোবেদা আমার স্ত্রী। সে দুই মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেল। পদ্ম শুরু করল নানান ক্যাঁচাল। আজ না, সাত দিন পরে বিয়ে। সাত দিন পরে বলে, ‘বিষ্যুদবারে আমি বিয়ে করব না। বিষ্যুদবার আমার জন্যে খারাপ।’ তখন অন্য ব্যবস্থা নিলাম। বিয়ে হয়ে গেল। সন্ধ্যাবেলা তাকে নিয়ে ট্রাক চালায়ে দিনাজপুর যাব—সব ঠিকঠাক। ট্রাক নিয়ে উপস্থিত হয়ে শুনি, তাকে আপনারা জোর করে তুলে নিয়ে গেছেন।
ভাইয়া বলল, এত দিন যখন অপেক্ষা করেছেন, আরও দশটা দিন যাক। সবুরে মেওয়া ফলে। আপনার বেলায় সবুরে বউ ফলবে।
সালামত বলল, আপনার কথা মানলাম। আসব দশ দিন পরে। তখন যদি কিছু না হয়, আমি অন্য লাইন ধরব। আমি এত সহজ পাত্র না। পদ্ম এটা জানে না, পদ্মর মা জানে। সবকিছুর মূলে আছে ওই বদমাগি।
শাশুড়িকে মাগি ডাকছেন, এটা কেমন কথা!
ক্ষুব্ধ সালামত ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
সালামতের আগমন এবং প্রস্থানে পদ্মর মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। সে কলপাড়ে বসে আছে। তার এক পা প্লাস্টিকের গামলায় ডোবানো। পায়ের জলচিকিৎসা চলছে। রহিমার মা গলা নামিয়ে তার সঙ্গে গল্প করছে।
গল্পের বিষয়বস্তু ড্রাইভার ইসমাইলের জিন। এই জিন ইসমাইলের সঙ্গেই সারাক্ষণ থাকে। শুধু শনিবার আর সোমবার থাকে না। এই দুই দিন জিন তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যায়। জিনের স্ত্রীর নাম হামাছা।