সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১৩, ২০১১
আমরা কেউ বাসায় নেই – ০৩
৩
পদ্ম এবং তার মা এ বাড়িতে আছে দশ দিন ধরে। পদ্মর মায়ের নাম সালমা। ভাইয়া তাকে ডাকছে ‘ছোট মা’। আমি ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, ওনাকে ছোট মা ডাকছ কেন?
ভাইয়া উদাস গলায় বলল, ঝামেলা লাগানোর জন্যে ‘ছোট মা’ ডাকছি, রগট ধর্মের অনুসারীরা ঝামেলা লাগাবে—এটাই তো স্বাভাবিক। আমার ‘ছোট মা’ ডাক শুনে বাবা আগুনলাগা মরিচবাতির মতো বিড়বিড় করে জ্বলবেন। মা ঘন ঘন ফিট হবেন। মজা না? দেখ, কেমন ঝামেলা লাগে।
ঝামেলা ভালোমতোই লেগেছে। পদ্ম-পরিবারের দশ দিন পার করার পর আমাদের সবার গতি ও অবস্থান জানানো যেতে পারে, যদিও কোনো কিছুরই গতি ও অবস্থান একসঙ্গে জানা যায় না। গতি জানলে অবস্থান বিষয়ে কিছু অনিশ্চয়তা থাকে, আবার অবস্থান জানলে গতির অনিশ্চয়তা। এসব জ্ঞানের কথা ভাইয়ার কাছ থেকে শোনা।
বাবা
তাঁর উঠানে চক্রাকার হণ্ঠন এবং ফ্রিহ্যান্ড একসারসাইজ এই কদিন বন্ধ। ভাইয়ার সঙ্গে তিনি কয়েকটা গোপন বৈঠক করেছেন। তাঁদের মধ্যে কী কথাবার্তা হয়েছে, জানি না। ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ভাইয়া কিছু বলেনি, শুধু মধুর ভঙ্গিতে হেসেছে।
বাবার সঙ্গে আমার একবারই কথা হয়েছে। তিনি আমাকে বলেছেন, তোমার বড় ভাই পদ্মর মাকে ছোট মা ডাকছে কেন?
আমি জানি না, বাবা।
তুমি কী ডাকো?
ওনার সঙ্গে আমার এখনো কোনো কথা হয়নি বলে কিছু ডাকার প্রয়োজন হয়নি।
প্রয়োজন হলে কী ডাকবে?
তুমি যা ডাকতে বলবে, তা-ই ডাকব। নাম ধরে ডাকতে বললে, সালমা ডাকব।
তোমার বড় ভাইকে আমি মঙ্গলবার পর্যন্ত সময় দিয়েছি, এটা জানো?
না।
মঙ্গলবার দুপুর বারোটার মধ্যে সে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।
ভাইয়া রাজি হয়েছে?
তার রাজি হওয়া-হওয়ির কী আছে? দিস ইজ মাই হাউস। তুমি যদি মনে করো তুমি তোমার ভাইয়ার সঙ্গে চলে যাবে, তুমিও যেতে পারো।
জি আচ্ছা, বাবা।
বিএ পাস করে ঘরে বসে আছো কেন? নড়াচড়া করবে না?
চাকরি খুঁজছি, বাবা। একটা মনে হয় পেয়েও যাব। ইন্টারভ্যু ভালো হয়েছে।
কী চাকরি?
শকুনশুমারির চাকরি। একটা এনজিওর সঙ্গে কথাবার্তা প্রায় ফাইনাল হয়ে গেছে। এনজিওর কাজ হচ্ছে বাংলাদেশের শকুনের পরিসংখ্যান করা।
ফাজলামি করছ?
জি না, বাবা। এনজিওর নাম Save the vulture. বাংলায় ‘শকুন বাঁচাও’।
বাবার চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তিনি মরিচবাতির মতো জ্বলছেন।
মা
মা পুরোপুরি শয্যা নিয়েছেন। আগে তাঁর হাঁপানি গ্যাপ দিয়ে দিয়ে হতো, এখন মেগাসিরিয়ালের মতো প্রতিদিনই হচ্ছে। হাঁপানির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কাশি।
সারাক্ষণই খক খক। মা ঘন ঘন আমাকে ডেকে পাঠান এবং ঘণ্টাখানেক কথা বলে নেতিয়ে পড়েন। প্রতিদিনই কথা শুরু হয় কাক দিয়ে এবং শেষ হয় পদ্মর মা দিয়ে।
মনজু, শোন। যেদিন ওই হারামজাদা কাকটা মানুষের চোখ ঠোঁটে নিয়ে বারান্দায় এসে বসেছে, সেদিনই বুঝেছি আমার সব শেষ।
মা, তুমি শোনো! মানুষের চোখ ওই কাক কোথায় পাবে? মরা গরু-ছাগলের চোখ নিয়ে এসেছে।
ওইটা ছিল মানুষের চোখ। গরু-ছাগলের চোখ আমি চিনি। আমি কচি খুকি না। এখন বল, টগর কেন পদ্মর মাকে ছোট মা ডাকে?
জানি না, মা।
আমার মনে সন্দেহ, তোর বাবা ওই মহিলাকে গোপনে বিয়ে করেছে। টগর বিষয়টা জানে বলে তাকে ছোট মা ডাকে।
হতে পারে।
হতে পারে না, এইটাই ঘটনা। টগর চিন্তাভাবনা ছাড়া কিছু করে না। সারা জীবন ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়া ছেলে। ছোট মা ডাকা উচিত বলেই সে তাকে ছোট মা ডাকছে।
এখন, মা, আমিও কি ওনাকে ছোট মা ডাকব?
কথাবার্তার এই পর্যায়ে মায়ের হাঁপানির টান প্রবল হলো। তিনি ডাঙার বোয়াল মাছের মতো একবার হাঁ করছেন, একবার মুখ বন্ধ করছেন।
একজন খাবি-খাওয়া মানুষের পাশে বেশিক্ষণ বসে থাকা যায় না। আমি উঠে পড়লাম।
মা বললেন, যাচ্ছিস কোথায়? বসে থাক। টগরকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারবি তোর বাবা ওই মহিলাকে বিয়ে করেছে কি না।
তুমি সরাসরি বাবাকে জিজ্ঞেস করো।
তোর বাবাকে এ রকম একটা কথা কীভাবে জিজ্ঞাসা করব?
ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করো। বাংলা ভাষা আমাদের কাছে খোলামেলা, ইংরেজির আব্রু আছে। ইংরেজিতে প্রশ্ন করলে বাবা খুশিও হবেন। তুমি বললে, ‘Is it true that you got married to Salma?’
মা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, একটা কাগজে লিখে দে। আমার মনে থাকবে না।
ভাইয়া
বাবা উঠানে চক্রাকারে ঘোরা বন্ধ করেছেন বলেই হয়তো ভাইয়া শুরু করেছে। প্রতি সন্ধ্যায় সে এই কাজ করছে। রাতে সে তার রগট ধর্ম নিয়ে খাতায় কী সব লিখছে! লিখছে উল্টা করে, কাজেই সরাসরি পড়ার উপায় নেই। আয়নার সামনে ধরে পড়তে হয়। একজন মানুষ পাতার পর পাতা উল্টা করে লিখে যাচ্ছে, এই ঘটনা বিস্ময়কর।
ব্যাঙা ভাই একদিন এসেছিল। অনেকক্ষণ ভাইয়ার সঙ্গে গুজগুজ করল। আমি আড়াল থেকে শুনলাম।
ওস্তাদ, দুই-একটা ভালো কথা বলেন, শুনি।
কোন বিষয়ে কথা শুনতে চাও?
আপনার যা ইচ্ছা বলেন।
শত্রু বিষয়ে বলব?
বলেন, শুনি।
একজন মানুষের মহা শত্রু হলো ঋণগ্রস্ত পিতা। সংস্কৃতে এই জন্যেই বলে ‘ঋণগ্রস্ত পিতা শত্রু’।
বলেন কী! জন্মদাতা পিতা শত্রু?
‘কান্তা রূপবতী স্ত্রী শত্রু’, অর্থাৎ, রূপবতী স্ত্রী শত্রু।
খাইছে আমারে! আমি পয়েন্টে পয়েন্টে ধরা খাইতেছি।
‘পুত্রঃ শত্রুরপণ্ডিতঃ।’ অর্থাৎ, মূর্খ পুত্রও শত্রু।
আমি গেছি ওস্তাদ, আমার চাইর দিকেই শত্রু। কাশেমের মা পরির চেয়েও সুন্দর। আর কাশেম মহামূর্খ। ক্লাস ওয়ান থাইকা টুতে উঠতে পারতেছে না, তিনবার ফেইল করছে। আমার বাবার কাজই ছিল ঋণ করা। ওস্তাদ, আরও দুই-একটা জ্ঞানের কথা বলেন, শুনি।
সাপ যখন মানুষের সামনে ফণা তোলে, তখন স্থির হয়ে থাকে না। ডানে-বামে সারাক্ষণ মাথা দোলায়। কেন, জানো? সাপের চোখ ফণার দুই দিকে। স্থির হয়ে থাকলে সে সামনের কিছু দেখতে পারে না বলেই সারাক্ষণ ফণা দোলায়। তার সামনে কী আছে, তা দেখার জন্যেই সাপকে ফণা দোলাতে হয়।
বিরাট একটা জিনিস শিখলাম। ওস্তাদ, পা-টা আগায়ে দেন। পা ছুঁইয়া সালাম করি।
ভাইয়াকে তার অদ্ভুত বন্ধুদের কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। ভাইয়া বলল, ওদের মাথায় শুধু একটা বিষয়ই আছে—তার নাম ‘অপরাধ’। ওরা সিঙ্গেল ট্র্যাক হয়ে গেছে। অপরাধ ছাড়া আর কিছুই এরা ভাবতে পারে না। তাদের মাথার পুরোটাই খালি। সেই শূন্য মাথায় বুদ্ধিমান মানুষ অনায়াসে ঢুকে ওদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আমি তা-ই করছি।
তুমি কি ক্রিমিনাল?
আমরা সবাই ক্রিমিনাল। মানুষ হয়ে জন্মানোর প্রধান শর্তই হচ্ছে, তাকে ক্রিমিনাল হতে হবে।
তাহলে মহাত্মা গান্ধীও ক্রিমিনাল?
ভাইয়া হাসতে হাসতে বলল, তুই আমার সঙ্গে তর্ক করতে আসবি না। তর্কে পারবি না।