আমি বললাম, বিয়ে হচ্ছে।
বাবা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ও আচ্ছা!
কার বিয়ে হচ্ছে, কী সমাচার, কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না, যেন অনেক দিন পর বাড়িতে ফিরে বিয়েবাড়ির হইচই দেখবেন এটাই স্বাভাবিক।
আমি বললাম, তোমার কি শরীর খারাপ?
বাবা ক্ষীণ গলায় বললেন, শরীর ঠিক আছে। তবে বিরাট ঝামেলায় আছি।
বাড়ি বিক্রির বাকি টাকাটা পাও নাই?
পেয়েছি। পুরোটাই পেয়েছি।
তাহলে আর ঝামেলা কী?
টাকাটা চুরি হয়ে গেছে। চুরি না, ডাকাতি। গতকাল সন্ধ্যার সময় পুরো টাকাটা পেয়েছি। রাত নয়টায় ট্রেনে উঠব। সব গোছগাছ করছি এমন সময় তিনজন লোক ঢুকল। একজনের হাতে ছুরি। গরু কোরবানি দেয় যে, এমন ছুরি। দুজন আমাকে জাপ্টে ধরে মেঝেতে শুইয়ে ফেলল। ছুরি হাতের লোক বলল, যা আছে দে। না দিলে জবাই করে ফেলব।
আমি বললাম, তুমি গরম পানি দিয়ে গোসল দাও। জামাল এসেছে, সে তোমার গায়ে সাবান ডলে দেবে। জামাল ফিরে এসেছে। ওই দেখো তোমার দিকে তাকিয়ে আছে।
বাবা জামালের দিকে তাকাতেই জামাল এগিয়ে এল, লজ্জিত গলায় বলল, আব্বা, ভালো আছেন?
বাবা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। তবে তাঁকে দেখে মনে হলো তিনি জামালকে ঠিক চিনতে পারছেন না। আমার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, টাকা চুরির বিষয়ে তোরা তোর মাকে কিছু বলিস না। মনে কষ্ট পাবে। এই অবস্থায় মনে কষ্ট পাওয়া ঠিক না। এতে রোগের প্রকোপ বাড়ে।
বাবার সঙ্গে মায়ের সাক্ষাৎকার অংশটি চমৎকার। বাবা মায়ের ঘরে ঢুকে বিছানার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াতেই মা মাথায় ঘোমটা দিয়ে বাবাকে বিছানায় শোয়া অবস্থাতেই হাত বাড়িয়ে কদমবুসি করলেন। বাবা বললেন, শরীরের অবস্থা কেমন?
মা বললেন, অনেক ভালো। ব্যথা দিনে দুইবারের বেশি ওঠে না। ব্যথাও আগের চেয়ে কম।
বাবা বললেন, Good.
মা বললেন, মনজু তোমার পুরোনো স্যুটের মাপে স্যুট বানাতে দিয়েছে। কোমরের ঘের এক গিরা বেশি দিয়েছে। তুমি একটু মোটা হয়েছ তো, এই জন্য। দোকানে গিয়ে ট্রায়াল দিয়ে এসো তো।
বাবা বললেন, আচ্ছা।
মা বললেন, তোমার স্যুটকেস আমি গুছিয়ে রেখেছি। টুথপেস্ট, ব্রাশ, শেভিং রেজার—সব ভরেছি। একটা জায়নামাজও নিয়েছি। হঠাৎ হঠাৎ তুমি নামাজ পড়ো তো, এই জন্য।
বাবা বললেন, ঠিক আছে।
বাড়িতে এত খাবারদাবার! বাবা কিছুই খেলেন না। পিরিচে করে সামান্য দই নিয়ে দুই চামচ মুখে দিয়ে শুয়ে পড়লেন। পায়ের কাছে বসে জামাল তাঁর পা টিপতে লাগল। বাবা ক্লান্ত গলায় বললেন, লেখাপড়া শিখতে হবে, বুঝলি। লেখাপড়া না শিখলে অন্যের পা টিপে জীবন পার করতে হবে। লেখাপড়া শিখবি না?
জামাল বলল, হুঁ, শিখুম।
বাবা বললেন, আধুনিক এক ইংরেজ কবির নাম সিলভিয়া প্লাথ।
জামাল বলল, জি, আব্বা।
বাবা বললেন, ছাত্রদের ক্লাসে একদিন তাঁর কবিতা পড়ে শোনালাম। কেউ অর্থ বুঝল না। লেখাপড়া না থাকলে যা হয়।
জামাল বলল, ঠিকই বলেছেন, আব্বা।
বাবা জ্বরের ঘোরে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন—
If I have killed one man, I have killed two
The vampire who said he was you
And dৎank my blood for a year…
সিলভিয়া প্লাথের এই দীর্ঘ কবিতা আমার ও ভাইয়ার মুখস্থ। বাবা মুখস্থ করিয়েছেন।
বাবার কাছে কবিতা মুখস্থের পরীক্ষা দিতে গিয়ে ভাইয়া পুরো কবিতা উল্টো করে বলল; যেমন—‘Two killed have I, man one killed have I if ’.
বাবা হতাশ গলায় বললেন, তোকে হেলিকপ্টারে করে নিয়ে পাবনার পাগলাগারদে রেখে আসা উচিত। দেরি করা ঠিক না।
নিমন্ত্রিত অতিথিরা সবাই চলে গেছে। ড্রাইভার ইসমাইল বউ নিয়ে গেছে নাখালপাড়া। সেখানে ইসমাইলের চাচার বাসায় বাসর হবে। বিয়ে উপলক্ষে প্রচুর গিফট উঠেছে। এর মধ্যে মালেক গ্রুপের প্রধান মালেক ভাই দিয়েছেন দুই ভরি ওজনের সোনার হার। যাঁর নাম প্রফেসর, তিনি দিয়েছেন দামি একটা মোবাইল ফোন। বরিশাল গ্রুপ দিয়েছে ১৪ ইঞ্চি কালার টিভি। পদ্মর মা দিয়েছেন একটা জায়নামাজ এবং কোরআন শরিফ। বনলতা দিয়েছে আকাশি রঙের দামি একটা জামদানি শাড়ি।
আমি ভাইয়াকে বললাম, সবাই কিছু না কিছু গিফট দিয়েছে, তুমি তো কিছুই দিলে না! তুমি হলে বিয়ের আসরের তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
ভাইয়া বলল, আমি কোনো উপহার দিইনি তোকে কে বলল? সবার আড়ালে গোপনে তাকে চমৎকার উপহার দিয়েছি।
কী উপহার?
তার পাছায় কষে একটা লাত্থি দিয়েছি, সে হুমড়ি খেয়ে দেয়ালে পড়েছে।
ভাইয়া হো হো করে হাসছে। আমি হাসতে গিয়ে হাসলাম না। অবাক হয়ে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তাকে কী সুন্দরই না লাগছে!
কলপাড় থেকেও হাসির শব্দ আসছে। পদ্ম ও বনলতা হাসছে। রাত বেশি হয়েছে বলে বনলতা থেকে গেছে। আজ রাতে সে পদ্মর সঙ্গে ঘুমাবে। অল্প সময়েই দুজনের ভেতর ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে।
সারা দিন তীব্র গরম ছিল। আকাশ ভর্তি মেঘ, কিন্তু মেঘ বৃষ্টি হয়ে নিচে নামছিল না। মধ্যরাতে মেঘের মানভঞ্জন হলো। মুষলধারায় বৃষ্টি পড়তে লাগল। ভাইয়া বলল, বৃষ্টিতে ভিজবি নাকি?
আমি বললাম, তুমি বললে ভিজব। তোমার রগট ধর্ম কী বলে? বৃষ্টিতে ভেজা যায়?
ভাইয়া বলল, ভেজা যায় না। আনন্দ হয় এমন কিছুই রগট ধর্মের অনুসারীরা করতে পারবে না। কষ্ট হয় এমন কিছুই শুধু করা যাবে। কষ্ট পাওয়া যায় এমন ঘটনা শোনা যাবে।