আওয়ামী লীগের নেতা ছানাউল্লাহ সাহেব, যাঁর নামে ছানাউল্লাহ সড়ক, দুবার আমাদের বাড়িতে এসেছেন। দুবারই পদ্মর মায়ের সঙ্গে দরজা ভেজিয়ে বৈঠক করেছেন। ছানাউল্লাহ সাহেবের এক সঙ্গীকে গজ-ফিতা নিয়ে বাড়ি মাপামাপিও করতে দেখা গেল। ভাইয়াকে ঘটনা জানাতেই সে বলল, অতি চালাক মহিলা। সে এই বাড়ি বিক্রির তালে আছে। ঝামেলার বাড়ি তো, বিক্রি করে খালাস হয়ে যাবে। ঝামেলা অন্যের ঘাড়ে যাবে—‘যা যস্য প্রকৃতিঃ স্বভাব জনিতা, কেনাপি ন প্রাজ্যতে’।
আমি বললাম, এর মানে কী?
ভাইয়া বলল, মানে বলতে পারব না। খুঁজে বের কর।
আমাদের পরিবারের অনেক নিরানন্দের মধ্যে একটি আনন্দের ব্যাপার হলো, আমি চাকরি পেয়েছি। বনলতা রিসার্চ সেন্টারে ফিল্ড ওয়ার্কারের চাকরি। মাসিক বেতন তিন হাজার টাকা। টিএ ডিএ আছে। দুই ঈদে বেতনের অর্ধেক বোনাস।
বনলতা অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আমার হাতে দিয়ে বলল, আপনাকে বলেছিলাম না, আমার বসকে বললেই আপনার চাকরি হয়ে যাবে?
বনলতা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছছে। আমি বললাম, কাঁদছ কেন?
আপনার চাকরি হয়েছে, এই আনন্দে কাঁদছি।
আমি বললাম, চাকরি হওয়ার আনন্দে আমি কাঁদব। তুমি কেন কাঁদবে?
বনলতা আগে টিপটিপ করে কাঁদছিল, এই পর্যায়ে শাড়িতে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে উঠল। উঠানে খাম্বা ধরে পদ্ম দাঁড়িয়ে আছে। সে বনলতার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০১, ২০১১
আমরা কেউ বাসায় নেই – ১০
আমরা কেউ বাসায় নেই – ১০
ড্রাইভার ইসমাইলের আজ বিয়ে। কনে রহিমার মা। চার লাখ টাকার কাবিন, অর্ধেক জেওর এবং শাড়িতে উসুল। বিয়ে পড়াচ্ছেন ব্যাঙা ভাইয়ের পরিচিত মাওলানা। বিয়ের খাবারের খরচ দিচ্ছে ব্যাঙা ভাই। হাজি নান্নামিয়া বাবুর্চি উঠানে ডেগ বসিয়ে রান্না চড়িয়েছে। আয়োজন ব্যাপক—
প্লেইন পোলাও
জালি কাবাব (সঙ্গে এক পিস পনির)
মুরগির রোস্ট (দেশি, ফার্মের না)
খাসির রেজালা
গরুর ভুনা
দই, মিষ্টি
কোক।
ব্যাঙা ভাই এত আয়োজন করেছে, কারণ এই উপলক্ষে দলের সবাই একত্র হবে। সবার একত্র হওয়ার জন্য উপলক্ষ লাগে। পদ্ম-উদ্ধার অভিযানে মাইক্রোবাসে আমার সহযাত্রীদের দেখতে পেলাম। ব্যাঙা ভাই আমাকে দরাজ গলায় বলল, ‘ভাইয়া! আপনার পরিচিত সবাইকে খবর দেন। ১০ জন ১২ জন কোনো বিষয় না। রাতে কাওয়ালির আয়োজন করেছি। বাচ্চু কাওয়াল আর তার দল। বিয়েশাদি গানবাজনা ছাড়া পানসে লাগে।
বনলতা ছাড়া আমার পরিচিত কেউ নেই। তাকে খবর দিলাম। সে সেজেগুজে উপস্থিত হলো। নিজেই আগ্রহ করে কনে সাজানোর দায়িত্ব নিল।
অতি আনন্দঘন পরিবেশে শুধু বরকে বিমর্ষ ও আতঙ্কগ্রস্ত দেখাচ্ছে। পাগড়ি-শেরওয়ানি পরে সে চুপসে গেছে। তাকে দিনাজপুর থেকে ধরে আনা হয়েছে। ভাইয়ার কাছে সে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে গল্প (বিশ্বাসযোগ্য) ফেঁদেছিল। গল্পটা এ রকম—
সে গাড়িতে তেল নেওয়ার জন্য পেট্রলপাম্পে গেছে। গাড়িতে তেল ভরা হচ্ছে, সে কাউন্টারে গেছে টাকা দিতে। টাকা দিয়ে গাড়িতে উঠতে গিয়ে দেখে পেছনের সিটে দুজন অপরিচিত লোক বসে আছে। একজনের হাতে পিস্তল। ঘাড়ে পিস্তল ঠেকিয়ে তারা ইসমাইলকে বগুড়ায় নিয়ে যায়। বগুড়ায় এই দুজনের সঙ্গে আরও তিনজন যুক্ত হয়। তারা গাড়ি নিয়ে হাইওয়েতে ডাকাতি করে। সেখান থেকে তারা তাকে নিয়ে যায় দিনাজপুরে।
গল্প শুনে ভাইয়া বলল, ডাকাতির ভাগ পাও নাই?
ইসমাইল বলল, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা তারা করেছে, আর ক্যাশ দিয়েছে তিন হাজার ৭০০ টাকা।
ভাইয়া বলল, টাকাটা আছে?
ইসমাইল বলল, তিন হাজার আছে।
ভাইয়া বলল, তিন হাজার টাকায় তো বিয়ে হয় না। যা-ই হোক, কী আর করা! টাকাটা নিয়ে ব্যাঙার সঙ্গে যাও। তোমার স্ত্রীর জন্য বিয়ের শাড়ি কিনে নিয়ে আসো। আজ সন্ধ্যায় রহিমার মায়ের সঙ্গে তোমার বিয়ে।
হতভম্ব ইসমাইল বলল, কাজের মেয়েকে আমি বিয়ে করব কেন?
ভাইয়া হাই তুলতে তুলতে বলল, কেন বিয়ে করবে তার কারণ তুমি ভালোই জানো। খামাখা কথা বলে আমাকে বিরক্ত করবে না। আজ একটা আনন্দের দিন। বাড়িতে বিয়েশাদি। এই দিনে বিরক্ত হতে ইচ্ছা করে না।
ইসমাইল বিড়বিড় করে বলল, ভাইজান, আপনি যা বলবেন তা-ই হবে।
সন্ধ্যার পর থেকে নিমন্ত্রিত অতিথিরা আসতে শুরু করল। ব্যাঙা ভাই কানে কানে আমাকে অতিথিদের পরিচয় দিতে লাগল। নকশাদার পাঞ্জাবি পরা সুন্দরমতো চেহারা যারে দেখতেছেন, তারে সবাই ডাকে প্রফেসর। ডেনজার আদমি। ভেরি ডেনজার।
আপনাদের দলের?
না, মালেক গ্রুপের। আমি সবাইরেই দাওয়াত দিয়েছি। বলা যায় না, মালেক ভাই আসতে পারেন।
আমি বললাম, পুলিশ এসে বাড়ি ঘেরাও করলে একসঙ্গে সবাইকে পেয়ে যাবে।
ব্যাঙা ভাই হাসতে হাসতে বলল, পুলিশের দুই কমিশনার দাওয়াতি মেহমান। ঘোগ থাকে বাঘের ঘরে। এই জন্য বলে ‘বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা’।
ভাইয়া! ওই দেখেন মালেকের বডিগার্ড। মনে হয় না ক্লাস নাইন টেনে পড়ে! বয়স অল্প হইলেও ধাইন্যা মরিচ। সে যখন আসছে, মালেক আসবে। বরিশাল গ্রুপও চলে আসবে, ইনশাল্লাহ।
বিয়েবাড়ির হইচই এবং ব্যস্ততার মধ্যে বাবা এসে উপস্থিত। তাঁকে দেখাচ্ছে কালবৈশাখী ঝড়ে চুপসে যাওয়া কাকের মতো। তিনি উঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হতাশ চোখে বিয়েবাড়ির আয়োজন দেখতে লাগলেন। আমি তাঁর কাছে এগিয়ে গেলাম। বাবা বললেন, কী হচ্ছে?