তলজগতে (Under world) ভাইয়ার প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখে আমি চমৎকৃত। ভাইয়ার অ্যান্টি-গ্রুপের প্রধান শামসু মারা গেছে। আমাদের বাসায় যে পত্রিকা আসে (দৈনিক সুপ্রভাত), তার প্রথম পাতায় ছবিসহ খবর ছাপা হয়েছে। খবরের শিরোনাম—
সাপের হাতে সাপের মৃত্যু
দলীয় কোন্দলে শীর্ষ সন্ত্রাসী শামসু নিহত
ছবিতে বিকৃত চেহারার একজনকে ফুটপাতে চিত হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। তার হাতে ছোট পানির বোতল। বোতলের মুখ খোলা হয়নি।
শামসুর মৃত্যুর পেছনে ভাইয়ার কলকাঠি আছে, তা বোঝা গেল ব্যাঙার আগমনে। সে এক বাক্স মিষ্টি নিয়ে এসেছে। আগে মিষ্টি আনা হতো হাঁড়িতে। এখন মিষ্টি আসে সুদৃশ্য কাগজের বাক্সে। রঙিন ফিতা দিয়ে সেই বাক্সে ফুল তোলা থাকে।
ব্যাঙা মিষ্টির বাক্স খুলল। সবাইকে মিষ্টি দেওয়া হলো। সবাই খেল, শুধু ভাইয়া বলল, না। রগট ধর্মের নীতিমালায় কোনো ঘটনাতেই আনন্দ প্রকাশ করা যায় না।
ভাইয়া রগট ধর্মে নতুন ধারা যুক্ত করেছে। এই ধর্মের অনুসারীদের বছরে একবার প্রাণী হত্যা করতে হবে। এমন প্রাণী, যার মাংস কোনো কাজে আসবে না। যেমন—কুকুর, বিড়াল।
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, প্রাণীদের মধ্যে মানুষ পড়ে কি না। ভাইয়া বলল, হোয়াই নট? নিম্নশ্রেণীর প্রাণী, নিজেদের হত্যা করতে হবে; তবে মানুষ প্রাণী কেউ নিজে হত্যা করতে না পারলে অন্যকে দিয়ে করালেও চলবে।
তোমার ধর্মে তীর্থস্থান বলে কিছু আছে?
ভাইয়া বলল, অবশ্যই আছে। যেসব জায়গায় একসঙ্গে অনেক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, সেসব জায়গাই রগট ধর্মের তীর্থস্থান।
আমি বললাম, পুণ্য অর্জনের জন্য ওই সব জায়গায় যেতে হবে?
ভাইয়া বলল, রগট ধর্মে পুণ্য বলে কিছু নেই। সবই পাপ। পাপ বাড়ানোর জন্যে এসব জায়গায় রগট ধর্মের লোকজন যাবে, আনন্দ-উল্লাস করবে।
আমি বললাম, ভাইয়া, ঠিক করে বলো তো, তুমি কি অসুস্থ?
ভাইয়া হাই তুলতে তুলতে বলল, অসুস্থতা রগট ধর্মের চাবিকাঠি।
শামসুর মৃত্যুর খবর ছাপা হওয়ার তিন দিনের মাথায় ড্রাইভার সালামত এসে উপস্থিত। ভয়ে-আতঙ্কে সে অস্থির। তাকে দেখাচ্ছে মৃত মানুষের মতো। সালামত বলল, ভাইজান! আমি আপনার পায়ে ধরতে আসছি।
ভাইয়া বলল, লাইফবয় সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে এসে পায়ে ধরো। নোংরা হাতে পায়ে ধরবে না। ভালো কথা, তোমার স্ত্রীর সঙ্গে কি কথা বলবে? পদ্মকে ডেকে দেব?
সালামত কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, এমন কথা মনেও স্থান দেবেন না। পদ্ম আমার কেউ না। আপনি অর্ডার দিলে আমি তারে মা ডাকব। এখন থেকে আমি আপনার হুকুমের চাকর।
পদ্ম আমার প্রতি অত্যন্ত নারাজ। তার নারাজির কারণ সম্ভবত বনলতা। এই মেয়েটি প্রায় রোজই আসছে। কেন, তা-ও স্পষ্ট নয়। আমাকে বলেছে, আমাদের বাড়ি তার অফিসে যাওয়ার পথে পড়ে এবং আমাদের বাসার চা অসাধারণ বলেই চা খাওয়ার জন্যে থামে।
পদ্ম আমাকে বলল, ওই নাকথ্যাবড়ি রোজ আসে কেন?
আমি বললাম, রোজ তো আসে না। মাঝেমধ্যে আসে।
কেন আসে?
আমার প্রেমে পড়েছে, এই জন্যে আসে।
পদ্ম বলল, আপনার প্রেমে পড়বে কেন? কী দেখে সে আপনার প্রেমে পড়বে? কী আছে আপনার?
আমার কিছুই নেই বলে সে আমার প্রেমে পড়েছে। আমার কিছু নেই বলে আমার প্রতি তার করুণা হয়েছে। করুণা থেকে প্রেম। এই প্রেমকে বলে ক-প্রেম। ঘৃণা থেকে প্রেম হয়, তাকে বলে ঘৃ-প্রেম। আমার প্রতি তোমার প্রেমের নাম ঘৃ-প্রেম।
আপনার প্রতি আমার প্রেম?
অবশ্যই। ঘৃ-প্রেম।
আপনার এই সব ফাজলামি আমি জন্মের মতো বন্ধ করতে পারি, এটা জানেন?
আগে জানতাম না, এখন জানলাম।
পদ্ম বলল, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে আমি আপনার বিরুদ্ধে মামলা করব। আমি বলব, গভীর রাতে দরজা ভেঙে আপনি আমার ঘরে ঢুকেছেন। রেপ করতে চেয়েছিলেন। আমার চিৎকার-চেঁচামেচিতে পালিয়ে গেছেন।
সাক্ষী কোথায় পাবে?
আমার মা সাক্ষ্য দেবেন। আমি কী করব জানেন? নিজেই নিজের শরীরে আঁচড়ে-কামড়ে দাগ করব। পুলিশকে বলব, এসব আপনি করেছেন।
পদ্ম ভয়ংকর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হয়, এই কাজ সে সত্যি সত্যি করবে। অবশ্য না-ও করতে পারে। এক ডাক্তার ছেলের সঙ্গে তার বিয়ের কথাবার্তা অনেক দূর এগিয়েছে। ছেলের নাম বদিউজ্জামান খান। ছেলে সুদর্শন। এমআরসিপি ডিগ্রি নিতে ইংল্যান্ড যাবে। যাওয়ার আগে বিয়ে করে বউ নিয়ে যাবে। পদ্মকে তার খুবই পছন্দ হয়েছে। বনলতা যেমন ঘন ঘন এ বাড়িতে আসে, ডাক্তার বদিউজ্জামান খানও আসে।
বিয়ে মোটামুটি ফাইনাল হওয়ার পর ধর্ষণজাতীয় মামলা-মোকদ্দমা হওয়ার কথা নয়। মেয়ে ধর্ষণ মামলা করছে শুনলেই পাত্রের পিছিয়ে যাওয়ার কথা।
গ্রামের বাড়ি থেকে সম্বোধনহীন একটি চিঠি এসেছে। এই চিঠি কার কাছে লেখা, বোঝা যাচ্ছে না। মনে হয়, সবার কাছেই লেখা। চিঠির সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে জামালও এসে উপস্থিত। জামালের কথা মনে আছে তো? ওই যে বাবার মানিব্যাগ ও মোবাইল ফোন নিয়ে পালিয়ে গেল।
জামাল খালি হাতে আসেনি। এক আঁটি সজনে এবং জাটকার চেয়ে এক সাইজ বড় ইলিশ মাছ নিয়ে এসেছে। যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে সে উঠান ঝাঁট দিতে শুরু করেছে। তাকে আমরা কেউ কিছুই বললাম না। শুধু রহিমার মা বলল, পুলা, তোর সাহস দেইখা ‘চমৎকার’ হইছি।
জামাল রহিমার মায়ের কথা ভ্রুক্ষেপও করল না। উঠান ঝাঁট দিয়ে সে তেলের বাটি নিয়ে ভাইয়ার পা মালিশ করতে বসল।
বাবা তাঁর চিঠিতে লিখেছেন—
‘বিরাট ঝামেলায় আছি। বাড়ি চার লাখ বিয়াল্লিশ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। বায়নার পঞ্চাশ হাজার টাকা ছাড়া কোনো টাকা এখনো পাই নাই। যার কাছে বিক্রি করেছি সে আজ দিব, কাল দিব করছে। বড় ভুল যা করেছি তা হলো, বাড়ি বিক্রির দলিলে সই করে দিয়েছি। এখন কী করব, কিছুই বুঝতে পারছি না।’