শকুন
পৃথিবীতে দুই ধরনের শকুন আছে। পুরোনো পৃথিবীর শকুন এবং নতুন পৃথিবীর শকুন। পুরোনো পৃথিবীর শকুন পাওয়া যায় আফ্রিকা, এশিয়া ও ইউরোপে। পরিবারের নাম Accipitrydae। এই পরিবারে আছে ইগল, বাজপাখি।
নতুন পৃথিবীর শকুন থাকে আমেরিকার উষ্ণ অঞ্চলে। এদের পরিবার পুরোনো পৃথিবীর পরিবারের সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত নয়। এই পরিবারের নাম Cathartidae। এদের বকপাখি গোত্রের মনে করা হয়।
শকুনকে (পুরোনো পৃথিবীর শকুন) বলা হয় ‘মেথর পাখি’। এরা গলিত শবদেহ (পশু, মানুষ) খেয়ে পরিষ্কার করে বলেই মেথর। এদের দৃষ্টিশক্তি ও ঘ্রাণশক্তি অসাধারণ; আকাশের অনেক ওপরে থেকেও গলিত শব দেখতে পায় এবং এর ঘ্রাণ পায়।
শকুন কখনো সুস্থ প্রাণীকে আক্রমণ করে না। তবে আহত প্রাণীকে করে।
পৃথিবীর দুটি অঞ্চলে কোনো ধরনের শকুন নেই। অস্ট্রেলিয়া ও অ্যান্টার্কটিকা।
শকুন গবেষণার হেড অফিস মিরপুরে। ছিমছাম তিনতলা বাড়ি। বাড়ির নাম ‘পবন’। এক ও দোতলায় শকুন গবেষণাকেন্দ্র। তিন তলায় ‘বনলতা সেন রিসার্চ সেন্টার’। এই রিসার্চ সেন্টারের কাজ হলো, জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেনকে খুঁজে বের করা। তবে এটা কোনো এনজিও নয়। ব্যক্তি-উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত রিসার্চ সেন্টার। এর কর্মীরা বনলতা সেনের পরিচয় উদ্ধারে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
আমি শকুন গবেষণাকেন্দ্রের ফিল্ড সুপারভাইজার আব্দুস সোবাহান মোল্লা সাহেবের সামনে বসে আছি। বিস্ময়কর ঘটনা হলো, ভদ্রলোকের চেহারায় শকুনভাব প্রবল। শকুনের মাথায় পালক থাকে না; এঁর মাথায় একটি চুলও নেই। শকুনের ঠোঁট লম্বা এবং নিচের দিকে বাঁকানো; মোল্লা সাহেবের নাক যথেষ্ট লম্বা এবং নিচের দিকে খানিকটা ঝুঁকে আছে। তাঁর চোখও শকুনের মতোই তীক্ষ । ভদ্রলোক আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, চাকরিতে জয়েন করতে এসেছেন?
আমি বললাম, জি।
মোটরসাইকেল নিয়ে এসেছেন?
আমি থতমত খেয়ে বললাম, মোটরসাইকেল কেন নিয়ে আসব? তা ছাড়া মোটরসাইকেল পাবই বা কোথায়?
মোল্লা সাহেব তাঁর তীক্ষ চোখ আরও তীক্ষ করে বললেন, আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারে লেখা আছে—ফিল্ডকর্মীরা নিজেদের মোটরসাইকেল নিয়ে আসবেন। মোটরসাইকেলে করে তাঁরা শকুন অনুসন্ধান করবেন।
আমি বললাম, স্যার, আমাদের এই এনজিওর কোনো শাখা কি অস্ট্রেলিয়ায় আছে?
মোল্লা সাহেব বললেন, আমাদের শাখা সারা পৃথিবীজুড়ে। অস্ট্রেলিয়ার খোঁজ কেন জানতে চাচ্ছেন?
আমি বিনয়ী গলায় বললাম, যদি সম্ভব হয়, আমাকে অস্ট্রেলিয়ায় ট্রান্সফার করে দিন। অস্ট্রেলিয়ার ফিল্ড অফিসাররা ঘরে বসে কাজ করতে পারবেন। তাদের মোটরসাইকেলের প্রয়োজন পড়বে না। কারণ, অস্ট্রেলিয়ায় কোনো শকুন নেই।
মোল্লা সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, যদি মোটরসাইকেল জোগাড় করতে পারেন তাহলে আসবেন। এখন বিদায়। অকারণ কথা শোনার সময় আমার নেই।
আমি শকুন অফিস থেকে বের হয়ে তিন তলায় বনলতা সেন রিসার্চ সেন্টারে চলে গেলাম। এখানে যদি মোটরসাইকেল ছাড়া চাকরি পাওয়া যায়।
বনলতা সেন অফিসটা দর্শনীয়। হালকা নীল রঙের বড় একটা ঘর হিম করে রাখা হয়েছে। একপাশে শাড়ি পরা (নীল রং) এবং খোঁপায় বেলি ফুলের মালা জড়ানো শ্যামলা এক মেয়ে কম্পিউটার নিয়ে বসে আছে। সব শ্যামলা মেয়ের চেহারায় দুঃখী দুঃখী ভাব থাকে। এই মেয়েটির চেহারায় দুঃখী ভাব প্রবল। তার চোখ বড় বড়। মনে হচ্ছে, কাঁদার জন্যে সে প্রস্তুত।
মেয়েটির ঠিক মাথার ওপর জীবনানন্দ দাশের ছবি। এর উল্টো দিকে বনলতা সেন কবিতাটি বাঁধানো।
আমি দুঃখী চেহারার মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেলাম। আমি কিছু বলার আগেই মেয়েটি বলল, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’ বনলতা সেনের মতোই ভাষ্য। মনে হয়, তাকে এভাবেই অভ্যর্থনা করতে বলে দেওয়া হয়েছে।
আমি বললাম, আপনাদের রিসার্চ সেন্টার সম্পর্কে কিছু জানতে এসেছি। আপনাদের কাজ কেমন এগোচ্ছে?
মেয়েটি বলল, খুবই ভালো। সবার ধারণা, বনলতা সেন থাকতেন রাজশাহীর নাটোরে। কথাটা ভুল। বরিশালের একটা গ্রামের নাম নাটোর। বীরভূমেও নাটোর আছে। বনলতা সেনের জন্যে এসব অঞ্চলেও আমরা অনুসন্ধান চালাচ্ছি।
কী ধরনের অনুসন্ধান?
পুরোনো নথিপত্র ঘাঁটা হচ্ছে। বয়স্ক মানুষের ইন্টারভিউ নেওয়া হচ্ছে। পত্রিকা দেখা হচ্ছে। আমরা আধুনিক প্রযুক্তি অর্থাৎ ইন্টারনেটের সাহায্যও নিচ্ছি।
আমি বললাম, আপনাদের কি ফিল্ডওয়ার্কার লাগবে? অনুসন্ধানের কাজে আমার ব্যাপক অভিজ্ঞতা আছে। এ মুহূর্তে আমি শকুন অনুসন্ধানের কাজে আছি। তবে শকুনের চেয়ে বনলতা সেনের অনুসন্ধান আনন্দময় হওয়ার কথা।
মেয়েটি বলল, চা খাবেন?
আমি বললাম, অবশ্যই খাব। আপনার নামটা কি জানা যায়?
মেয়েটি বলল, আমার নাম বনলতা। এটা নকল নাম। আসল নাম শ্যামলী। আমার বস ‘বনলতা’ নাম দিয়েছেন। বসের ধারণা, আমার চেহারা বনলতা সেনের মতো।
উনি কি বনলতা সেনকে দেখেছেন?
না। ওনার কল্পনার বনলতা।
আপনার বস কি বিবাহিত?
বনলতা হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বলল, ওনার দুই ছেলে, দুই মেয়ে। বস আমাকে খুব পছন্দ করেন। ওনাকে বললে আপনার চাকরি হয়ে যাবে। আপনি একটা বায়োডাটা দিয়ে যান।
বায়োডাটা তো সঙ্গে নিয়ে আসিনি।
আপনি মুখে মুখে বলুন, আমি কম্পিউটারে নিয়ে নিচ্ছি।
আমি বনলতার সঙ্গে চা খেলাম। দুপুরের লাঞ্চ করলাম। খুবই আশ্চর্যের কথা, বনলতা অফিসের গাড়িতে করে আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে গেল।
কখনোই কোনো মেয়ে আমার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখায়নি। বনলতা কেন আগ্রহ দেখাচ্ছে, তা বুঝতে পারছি না। আমার চেহারার সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের চেহারায় কোনো মিল কি আছে? ভালো করে আয়না দেখতে হবে।