আমাদের সবার তিন মাসের ভিসা হয়েছে। মা ক্যানসারের ব্যথা ভুলে আনন্দে ঝলমল করছেন। বাবাকে ডেকে বললেন, আমার একটা কথা তোমাকে রাখতেই হবে। ‘না’ করতে পারবে না। ক্যানসার হয়েছে, মারা যাব—এটা তো জানোই, ধরে নাও একজন মৃত মানুষের কথা।
বাবা বললেন, বলো, কী কথা।
রাখবে তো?
রাখব।
মা বললেন, টগর-মনজু প্রথমবারের মতো বিদেশ যাচ্ছে। ওদের স্যুট কিনে দিতে হবে। ওরা স্যুট-টাই পরে যাবে। স্যুট-টাই, নতুন জুতা।
বাবা বললেন, এসব তুমি কী বলছ?
মা বললেন, তুমিও নতুন স্যুট কিনবে। লাল রঙের টাই।
মা কিশোরী মেয়েদের মতো আহ্লাদী হাসি হাসতে লাগলেন।
বাবা বললেন, তুমি আমার অবস্থা বুঝতে পারছ না। মাত্র আশি হাজার টাকা জোগাড় হয়েছে। এই টাকায় যাওয়া-আসার টিকিট হবে, তোমার চিকিৎসা হবে না।
মা বললেন, আমার চিকিৎসার দরকার নাই। যাওয়া-আসা হলেই হবে। তবে তিনজনেরই নতুন স্যুট লাগবে।
গ্রামের বসতবাড়ি বিক্রি করার জন্যে বাবা চলে গেলেন। আমাকে সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন, আমি নানান অজুহাত দেখিয়ে কাট মারলাম। চাকরিতে জয়েন করব, শুরুতেই অ্যাবসেন্ট হওয়া যাবে না। কথাটা মিথ্যা নয়। সোমবার আমার জয়েন করার কথা। শকুনশুমারি সামনের মাসের এক তারিখ থেকে শুরু হবে।
বাবার বসতবাড়ির কথা এই ফাঁকে বলে নিই। বসতবাড়িটা বেশ সুন্দর। বেশির ভাগ দরজা-জানালা ভেঙে পড়ে গেলেও দক্ষিণমুখী একতলা পাকা বাড়ি। বাড়ির পেছনে পুকুর। পুকুরে বাঁধানো ঘাট আছে। ঘাট এখনো নষ্ট হয়নি। বর্ষায় পুকুর ভর্তি পদ্ম ফুল ফোটে। দুপুর বারোটায় সব ফুল একসঙ্গে বুজে যায়। অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য। পুকুরের চারপাশে আম-কাঁঠালের বাগান ছিল, এখন হয়েছে আম-কাঁঠালের জঙ্গল। সুন্দর এই জায়গাটা অন্যের হাতে চলে যাবে, ভাবতে খারাপই লাগছে। উপায় কী?
বাবার অনুপস্থিতি আমাদের জীবনযাত্রায় তেমন প্রভাব ফেলল না। যখন ব্যথা থাকে না, তখন মা আগের মতোই ডিভিডি প্লেয়ারে হিন্দি ছবি দেখেন। পাড়ায় নতুন একটা ডিভিডির দোকান হয়েছে। নাম ‘ডিভিডি হোম সার্ভিস’। এরা বাড়ি বাড়ি ডিভিডি সাপ্লাই করে এবং নিয়ে যায়। ভাড়া দৈনিক কুড়ি টাকা। মা তাদের সক্রিয় সদস্য।
ভাইয়া আগের মতোই শুয়ে শুয়ে বই পড়ে সময় কাটাচ্ছে। গৃহত্যাগের কথাবার্তা তার মুখ থেকে শোনা যাচ্ছে না। মায়ের অসুখের কারণে গৃহত্যাগ সাময়িক স্থগিত কি না, তা-ও বুঝতে পারছি না। ভাইয়া দাড়ি-গোঁফ কামানো সাময়িক বন্ধ রেখেছে। এখন তার মুখ ভর্তি দাড়ি। তাকে অন্য রকম দেখাচ্ছে। চেহারায় ঋষি ভাব আসি আসি করছে।
বাবার গাড়িটা মনে হয় শেষটায় ঠিকঠাক হয়েছে। ড্রাইভার ইসমাইল রোজই গাড়ি নিয়ে বের হচ্ছে। পেছনের সিটে সেজেগুজে পদ্ম এবং তার মা বসে থাকেন। নিয়মিত গাড়িতে চলার কারণেই কি না কে জানে, ভদ্রমহিলার চেহারা উজ্জ্বল হয়েছে। আগে তিনি ঠোঁটে লিপস্টিক দিতেন না; এখন দিচ্ছেন।
পদ্ম ভালো আছে। সুখে এবং আনন্দে আছে। সে নতুন একটা খেলা শিখেছে। খেলার নাম সুডুকু। জাপানি কী একটা অঙ্কের হিসাবের খেলা। সে আমাকে বোঝাতে চেয়েছিল। আমার গবেট মাথায় বিষয়টা ঢোকেনি। পদ্ম হতাশ হয়ে বলেছে, আপনাকে দেখে যতটা বোকা মনে হয়, আপনি তার চেয়েও বোকা।
আমার ভাইয়ার অবস্থা কী?
পদ্ম বলল, তাঁর চেহারায় গবেট ভাব আছে, তবে তিনি বুদ্ধিমান।
আমি বললাম, ভাইয়া বুদ্ধিমান কী করে বুঝলে? তার সঙ্গে তো তোমার কথা হয় না।
পদ্ম বলল, কে বোকা, কে বুদ্ধিমান তা জানার জন্যে কথা বলতে হয় না। চোখ দেখেই বোঝা যায়। আপনাদের এই বাড়িতে সবচেয়ে বোকা রহিমার মা। তার পরই আপনি।
বোকামির দিক থেকে ফার্স্ট হওয়া গেল না?
না।
পদ্ম সুডুকু খেলা বন্ধ করে বলল, আমি যদি আপনাকে একটি জটিল প্রশ্ন করি আপনি উল্টাপাল্টা জবাব দেবেন। রহিমার মা কিছুই বলতে পারবে না। কিন্তু আপনার ভাই চমৎকার জবাব দেবেন।
আমি বললাম, প্রশ্নটা কী?
পদ্ম বলল, ছেলে ও মেয়ের মধ্যে যখন প্রেম হয়, সেই প্রেমটা আসলে কী?
আমি বললাম, প্রেম হচ্ছে দুজনে একসঙ্গে ফুসকা খাওয়া। রিকশায় করে বেড়ানো। রাত জেগে মোবাইলে কথা বলা।
পদ্ম বলল, আপনার কাছ থেকে এই উত্তরই আশা করছিলাম। রহিমার মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে বলল, পিরিতিরে বলে প্রেম। ভালো কথা, রহিমার মা যে প্রেগন্যান্ট, এটা জানেন?
আমি চমকে উঠে বললাম, না তো!
সে আড়ালে-আবডালে বমি করে বেড়াচ্ছে।
বলো কী?
পদ্ম বলল, সন্তানের বাবা কে, আন্দাজ করতে পারছেন?
না।
আমি জানি।
জানলে বলো কে?
আমি বলব কেন! আপনি খুঁজে বের করুন।
পদ্ম সুডুকু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমি কী করব বুঝতে পারছি না। বসে থাকব, না ভাইয়ার কাছে যাব? শকুন বিষয়ে কিছু তথ্য জানব। প্রথম দিনের চাকরিতে শকুন বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে যদি উত্তর না দিতে পারি, তাহলে লজ্জার বিষয় হবে।
পদ্ম মনে হয় সুডুকু ঝামেলা শেষ করেছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল। আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললাম—‘কাহারও হাসি ছুরির মতো কাটে, কাহারও হাসি অশ্রুজলের মতো।’ পদ্মর হাসি ছুরির মতো কাটে।
পদ্ম বলল, প্রেম বিষয়ে আমার কাছ থেকে জানতে চান? আমার ব্যাখ্যা?
বলো।
পদ্ম গম্ভীর মুখে বলল, প্রেম হলো এক ধরনের আবেগ, যা লুকানো থাকে। প্রেমিককে দেখে প্রেমিকার সেই আবেগ লুকানো অবস্থা থেকে বের হয়ে আসে। তখন হার্টবিট বেড়ে যায়। ঘাম হয়। পানির পিপাসা হয়। একসঙ্গে প্রবল আনন্দ এবং প্রবল বেদনা হয়। আনন্দ—কারণ, প্রেমিক সামনে আছে। বেদনা— কারণ, কতক্ষণ সে থাকবে কে জানে!
আমি বললাম, বাহ! ভালো বলেছ।
পদ্ম হাই তুলতে তুলতে বলল, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে প্রেমের ডেফিনেশন দিলাম। আপনি আশপাশে থাকলে আমার মধ্যে এই ব্যাপারগুলো ঘটে।
আমি বললাম, ঠাট্টা করছ?
পদ্ম বলল, হ্যাঁ। ঠাট্টা যে বুঝতে পারছেন, তার জন্যে ধন্যবাদ।
ভাইয়ার কাছ থেকে শকুন বিষয়ে যা জানলাম, তার সারসংক্ষেপ—