বাবাকে যথেষ্টই অস্থির দেখাচ্ছে। সালামতের মতোই অস্থির। অস্থিরতার কারণ, ডাক্তাররা বলছে মায়ের পেটে ক্যানসার।
ভাইয়া বলল, ডাক্তার কখন বলল?
রাত আটটার সময় রিপোর্ট আনতে গিয়েছিলাম, তখন বলল। তোমার মাকে এখনো কিছু বলিনি। বলব কি না বুঝতে পারছি না। আমার মনে হয় বলা উচিত। টগর, তুমি কী বলো?
ভাইয়া বলল, বলা উচিত।
তাহলে তুমি তোমার মাকে বুঝিয়ে বলো, যাতে ভয় না পায়। চিকিৎসার আমি ত্রুটি করব না। প্রয়োজনে ঘরবাড়ি, জমি—সব বেচে দিব।
ভাইয়া বলল, কীভাবে বেচবে? সব তো পদ্মর মার নামে। অবশ্যি নকল দলিল।
বাবা বললেন, এই ঝামেলা তুমি বাজিয়েছ, তুমি ঠিক করো। It is an order.
ভাইয়া বলল, একদিকে ঝামেলা ঠিক করলে অন্যদিকে ডাবল ঝামেলা দেখা যায়, কাজেই ঝামেলা ঠিক করা অনুচিত।
বাবা হতাশ গলায় বললেন, আমি তাহলে কী করব? তুমি কি জানো, পদ্মর মা আমাকে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিয়েছে?
জানি। ঝামেলা না বাড়িয়ে তোমার উচিত বাড়ি ছেড়ে দেওয়া।
আমি কোথায় থাকব?
পথেঘাটে থাকবে। ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে ইংরেজিতে ভিক্ষা করবে। রাতে ঘুমাবার জন্যে চলে যাবে কমলাপুর রেলস্টেশনে। ভবঘুরেদের জন্যে সেখানে ঘুমাবার ভালো ব্যবস্থা আছে।
বাবা তাকিয়ে আছেন। মায়ের ক্যানসারের খবরে তার মধ্যে যে প্রবল হতাশা তৈরি হয়েছিল, তা কেটে গেছে। এখন তিনি বিস্মিত।
বাবা চাপা গলায় বললেন, আমি ইংরেজিতে ভিক্ষা করব আর রাতে কমলাপুর রেলস্টেশনে ঘুমাব?
ভাইয়া বলল, তুমি একা মানুষ। যেকোনো জায়গায় ঘুমাতে পারো।
আমি একা?
মা তো ক্যানসারে মারাই যাচ্ছে। মায়ের মৃত্যুর পর তুমি একা হয়ে যাচ্ছ। আমার মনে হয়, এই মুহূর্তে তোমার উচিত পদ্মর মায়ের কাছ থেকে গ্রেসপিরিয়ড নেওয়া। মায়ের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তুমি এ বাড়িতে থাকবে। মৃত্যুর পর কুলখানির দিন গৃহত্যাগ করবে।
তুমি এই ধরনের কথা বলতে পারছ? তোমার জন্মদাতা মা। মা নিয়ে বিকট কথা! আর আমি তোমার বাবা।
ভাইয়া হেসে ফেলল।
বাবা অবাক হয়ে বললেন, তুমি হাসছ?
হাসি এলে কী করব, বলো। হাসি চেপে রাখব? তুমি বোধহয় জানো না, হাসি চেপে রাখতে প্রচণ্ড এক শারীরিক প্রেশার হয়। এই প্রেশারে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। থ্রম্বসিস হতে পারে।
ইউ গেট লস্ট।
ভাইয়া উঠে দাঁড়াল। আমি অবাক হয়ে দেখি, তার ঠোঁটের কোনায় এখনো হাসি লেগে আছে।
বাবাও অবাক হয়ে ভাইয়ার ঠোঁটের হাসি দেখছেন। বাবা বললেন, তোমার মাকে তুমি কিছু বলতে যাবে না। তুমি মস্তিষ্কবিকৃত একজন মানুষ। কী বলতে কী বলবে, তার নেই ঠিক।
মায়ের সঙ্গে কথা বলতে পারব?
বাবা জবাব দিলেন না। ভাইয়া রওনা হলেন মায়ের শোবার ঘরের দিকে। পেছনে পেছনে আমি।
ভাইয়া বলল, কেমন আছ, মা?
মা বলল, ভালো। আজ ব্যথা নাই।
ভাইয়া বলল, মা, তোমাকে একটা প্রশ্ন করছি, ভেবেচিন্তে জবাব দিবে। বলো তো তোমার গায়ের রক্ত আছে, এমন কাউকে কি তুমি খুন করতে পারবে?
তুই কি পাগল হয়ে গেলি? আমার শরীরে রক্ত আছে এমন কাউকে আমি কীভাবে খুন করব?
ভাইয়া বলল, ঘরে ঢুকতেই দেখলাম তুমি একটা মশা মারলে। মশার গায়ে তোমার রক্ত।
মা হতাশ চোখে তাকাচ্ছেন। তাঁকে চিন্তিত মনে হচ্ছে। ভাইয়ার ঠোঁটের কোনায় মিটিমিটি হাসি।
[চলবে]
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ১০, ২০১১
আমরা কেউ বাসায় নেই – ০৮
৮
মা জেনেছেন, তাঁর পাকস্থলীতে ক্যানসার। অল্পদিনের মধ্যেই মারা যাবেন। তিনি যে খুব চিন্তিত, এ রকম মনে হচ্ছে না। এত বড় অসুখ বাঁধানোয় নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন। অন্যদের সঙ্গে টেলিফোনের কথাবার্তায় সে রকমই মনে হয়। তাঁর টেলিফোনে কথাবার্তার নমুনা—
রুনি! আমার খবর শুনেছিস। কী আশ্চর্য! কেউ বলে নাই? আমার ক্যানসার হয়েছে। চিকিৎসা চলছে। বাঁচব মনে হয় না। কথায় আছে না, ক্যানসার নো আনসার। ক্যানসারের কারণে বিদেশ যাচ্ছি। টগরের বাবা বলেছে, আমাকে ব্যাংককে নিয়ে যাবে। দুই ছেলেকেও সঙ্গে নিয়ে যাবে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে দলবেঁধে বেড়ালাম। সেখানে ‘পাতায়া’ বলে একটা জায়গা আছে, খুব সুন্দর।
এমন অনেক আত্মীয়স্বজন বাসায় আসছেন, যাঁদের আগে কখনো দেখা যায়নি। খালি হাতে কেউ আসছেন না। ডাব, পেঁপে, হরলিক্সের কৌটা জড়ো হচ্ছে। মা প্রতিটি আইটেমের হিসাব রাখছেন। উদাহরণ, ‘মনজু! ডাব চারটা ছিল, আরেকটা গেল কই?’
মা আনন্দিত, তবে বাবা বিধ্বস্ত। বিদেশযাত্রার খরচ তুলতে পারছেন না। গাড়ি বিক্রি করতে চেয়েছিলেন, সেটা সম্ভব হলো না। দেখা গেল, গাড়ির কাগজপত্রও পদ্মর মায়ের নামে। বাবা অবাক হয়ে ভাইয়াকে বললেন, তুমি গাড়ির কাগজপত্রও ওই মহিলার নামে করিয়ে দিয়েছ?
ভাইয়া বলল, না। এটা উনি নিজে নিজেই করেছেন। বাড়ির নকল কাগজপত্র তৈরি করে পথ দেখিয়ে দিয়েছি, এতেই কাজ হয়েছে। উনি নিজেই এখন পথ বানিয়ে এগোচ্ছেন। মহীয়সী মহিলা!
কী মহিলা বললি?
মহীয়সী মহিলা। পলিটিকসে ভালো কেরিয়ার করতে পারবেন। প্রথমে মহিলা কমিশনার, তারপর পৌরসভার চেয়ারম্যান, সেখান থেকে এমপি। এমপি হওয়ামাত্র তোমার এই গাড়ি বাতিল। নতুন শুল্কমুক্ত গাড়ি।
বাবা বললেন, খামাখা কথা বলছ কেন? চুপ করো।
ভাইয়া চুপ করলেন। বাবা গেলেন পদ্মর মায়ের কাছে। তিনি আগে পদ্মর মাকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠাতেন। এখন ডাকলে আসেন না বলে নিজেই যান। তাদের ঘরের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে খুক্ খুক্ করে কাশেন। দেখে মায়া লাগে।
বেশ অনেকবার কাশাকাশির পর পদ্মর মা বের হয়ে এলেন। বিরক্ত গলায় বললেন, কিছু বলবেন?
গাড়ির বিষয়ে একটা কথা ছিল।
কী কথা?
গাড়ির আপনি নতুন করে কাগজপত্র করিয়েছেন। এখন গাড়িও আপনার নামে।
পদ্মর মা বললেন, এটাই তো হবে। বাড়িভাড়া হিসেবে মাসে বিশ হাজার করে টাকা গাড়ির দামের সঙ্গে কাটা যাচ্ছে। মাসে বিশ হাজার টাকা দিতে বলেছিলাম। এক পয়সা কি দিয়েছেন?
নিজের বাড়িতে থাকব আবার বাড়িভাড়াও দেব!
পদ্মর মা বললেন, পুরোনো কথা তুলবেন না। পুরোনো কথা শোনার সময় আমার নাই।
বাবা প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, আমি কত বড় বিপদে আছি, আপনি তো জানেন।
পদ্মর মা বললেন, আপনি এখন বিপদে পড়েছেন। আমি পদ্মর বাবার মৃত্যুর পর থেকেই বিপদে আছি। আমাকে আপনি বিপদের কথা শোনাবেন না। মায়ের কাছে মাসির গল্প করবেন না।
বাবা বললেন, আপনার বিপদে আমি সাধ্যমতো সাহায্যের চেষ্টা করেছি। মাঝেমধ্যে টাকা-পয়সা পাঠিয়েছি। আপনাকে আশ্রয় দিয়েছি।
পদ্মর মা বললেন, ভাইসাহেব, উল্টা কথা বলবেন না। আশ্রয় আপনি দেন নাই। আশ্রয় আমি আপনাদের দিয়েছি। আমার জমিতে তোলা বাড়িতে থাকতে দিয়েছি। আপনার সঙ্গে এই নিয়ে আর বাহাস করতে পারব না। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হয় জ্বর আসবে।
হতাশ বাবা ডিকশনারি হাতে কলতলায় বসে রইলেন।