আমি পড়েছি ম্যাডাম।
মিথ্যা কথা বলবে না। তুমি পড় নাই। আমি দেখেছি তুমি শুধু পৃষ্ঠা উল্টে গেছ।
না ম্যাডাম, আমি পড়েছি।
ম্যাডাম এবারে ধমক দিলেন, তুমি পড় নাই।
টিয়া কী করবে বুঝতে পারছিল না তখন টিয়ার পাশে বসে থাকা ছেলেটা তাকে সাহায্য করল, সে ম্যাডামকে বলল, ম্যাডাম, টিয়া পড়েছে। টিয়া খুব তাড়াতাড়ি পড়তে পারে।
তাড়াতাড়ি পড়তে পারে?
ছেলেটা চোখ বড় বড় করে বলল, জী ম্যাডাম, টিয়া এই মোটা মোটা বই এক টানে পড়ে ফেলতে পারে!
ম্যাডাম আবার ভুরু কুঁচকে তাকালেন, কিন্তু ততক্ষণে ক্লাশের অন্য ছেলে মেয়েরাও কথা বলতে শুরু করেছে। তারা বলতে লাগল, জী ম্যাডাম, টিয়া খুব তাড়াতাড়ি পড়তে পারে। আমরা যখন এক লাইন পড়ি সে তখন এক পৃষ্ঠা পড়ে ফেলে। বিশ্বাস না করলে তাকে পড়তে দেন ম্যাডাম! পড়তে দেন।
ম্যাডাম তখন তার ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে বইটার একটা পৃষ্ঠা বের করে টিয়ার হাতে দিয়ে বললেন, পড় দেখি এই পৃষ্ঠাটি।
টিয়া বইটি হাতে নিল পৃষ্ঠাটার উপর চোখ বুলিয়ে বইটা ফিরিয়ে দিল। ম্যাডাম অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে টিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, তুমি তো পড় নাই, শুধু চোখ বুলিয়েছ।
না ম্যাডাম পড়েছি। ভালো করে পড়েছি।
বল দেখি কী লেখা আছে এখানে।
টিয়া প্রায় দাড়ি কমাসহ কী লেখা আছে বলে দিতে শুরু করল এবং পৃষ্ঠার মাঝামাঝি আসার পর ম্যাডাম বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, আর বলতে হবে না। আমি বিশ্বাস করেছি।
টিয়ার জন্যে পুরো ক্লাস এবার আনন্দে চিৎকার করে উঠল, যেন টিয়া নয় তারাই ম্যাডামকে চমৎকৃত করেছে।
ম্যাডাম অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, কী আশ্চর্য! কী চমৎকার! কী অসাধারণ! তারপর টিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কীভাবে এটা করতে শিখেছ?
টিয়া লাজুক মুখে বলল, পড়তে পড়তে হয়ে গেছে ম্যাডাম।
তুমি কী অনেক বই পড়?
জী ম্যাডাম।
কার কার বই পড়েছ?
সবার বই পড়েছি। এখন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই পড়ছি।
ম্যাডাম একটু খাবি খেলেন, মা-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়?
জী ম্যাডাম। শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ শেষ করেছি।
রবীন্দ্রনাথ?
শুধু গল্পগুচ্ছ পড়েছি। আর নৌকাডুবি।
ম্যাডাম চোখ বড় বড় করে টিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন ক্লাশের ছেলে মেয়েরা আনন্দে চিৎকার করতে লাগল। তাদের চিৎকার শুনে মনে হতে লাগল, শুধু টিয়া নয় যেন তারা সবাই গল্প গুচ্ছ আর নৌকাডুবি পড়ে শেষ করে ফেলেছে!
.
এই হচ্ছে রাহেলা খাতুনের পাঁচজন নাতি নাতনির পরিচয়। সবচেয়ে বড় জন হচ্ছে রিতু, রীতিমতো তেজী একজন নেতা। টিটন একজন খাঁটি বিজ্ঞানী, সবচেয়ে ভালো ছাত্র হওয়ার পরেও রোল নম্বর সব সময় পনেরো না হয় ষোলো। কারণ অঙ্ক আর বিজ্ঞান ছাড়া আর সব সাবজেক্টে তাকে টেনে টুনে পাস করতে হয়! তিতু হচ্ছে ছোট একটা শরীরে আটকে থাকা একজন মহাপুরুষ। টিয়া হচ্ছে জ্ঞানতাপস, পাঁচজনের ভেতর একমাত্র মানুষ যার চোখে চশমা এবং সবচেয়ে ছোট জন হচ্ছে মিঠুন, পৃথিবীর সেরা দুষ্টুদের একজন। যার সম্পর্কে যত কম কথা বলা যায় তত ভালো। একদিন বিকেলে দেখা গেল রাহেলা খাতুনের এই পাঁচ নাতি-নাতনি একটা জরুরি মিটিংয়ে বসেছে।
০৩. যখন জরুরি মিটিং
চার তালার ছাদে অর্ধসমাপ্ত ঘরটা বাচ্চাদের দখলে, সেখানেই মিটিংটা বসেছে। ঘরের এক কোনায় একটা বইয়ের শেলফ, এক কোনায় টিটনের কিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি। এছাড়া এই ঘরে আর কোনো ফার্নিচার নাই তাই সবাই মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসেছে। মিটিংটা ঠিক করে চালানোর জন্য রিতুর হাতে দুধের একটা খালি কৌটা এবং একটা বড় চামুচ। রিতু চামুচ দিয়ে কৌটার ওপর ঘটাং ঘটাং করে দুই ঘা মেরে বলল, অর্ডার। অর্ডার।
রিতুর অর্ডার অর্ডার শুনে কোথা থেকে জানি মিঠুন দুই দিকে দুই হাত মেলে প্লেনের ইঞ্জিনের মতো গর্জন করতে করতে ছুটে এসে সবার মাঝখানে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ব্যাপারটি নিয়ে কেউ অবাক হলো না বরং এরকম কিছু না করলেই সবাই অবাক হতো। শুধু রিতু গম্ভীর গলায় বলল, মিঠুন, আমি যে অর্ডার অর্ডার বলেছি সেই কথাটা কানে যায় না?
মিঠুন উঠে বসে গা ঝাড়া দিয়ে বলল, অর্ডার দাও। আমি কি না করেছি? কী অর্ডার দেবে? পিজা নাকি ফ্রায়েড চিকেন?
ফাজলামো করবি না মিঠুন, ভালো হবে না কিন্তু।
আমি কখন ফাজলামো করলাম? তুমিই না বলেছ অর্ডার, অর্ডার।
অর্ডার মানে হচ্ছে শান্ত হয়ে বসা। গাধা কোথাকার।
রিতুর পাশে টিটন বসেছিল সে রিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, আপু, তুমি কেন খামাখা মিঠুনকে শান্ত হয়ে বসতে বলেছ? মিঠুন কোনোদিন শান্ত হয়ে বসতে পারবে? মিঠুন জীবনেও কোনোদিন শান্ত হয়ে বসেছে?
তিতু মিঠুনকে ধরে আদর করে বসাতে বসাতে বলল, মনে নাই মামি বলেছে মিঠুন যখন মামির পেটের ভিতরে ছিল তখনো সে শান্ত হয়ে থাকে নাই। সব সময় পেটের ভিতরে ঢুশ ঢাশ মারতো!
মিঠুন তিতুর পাশে ঠেলাঠেলি করে বসতে বসতে জিব বের করে তিতুর কনুইয়ের খানিকটা চেটে ফেলল। সেটা দেখেও কেউ খুব অবাক হলো না শুধু তিতু বলল, কী করলি তুই? আমাকে চাটলি কেন?
মিঠুন দাঁত বের করে হেসে বলল, তোমার নাম তো তিতু তাই তোমাকে চেটে দেখলাম তুমি কী আসলেই তিতা কী না।
কী দেখলি?
তুমি তিতা না। তুমি হচ্ছ নোতা। তোমার নাম রাখা উচিৎ ছিল নোনতু।