মিঠুনের দুষ্টুমির বর্ণনা দিতে হলে শুধু তাকে নিয়েই মোটা একটা বই লিখতে হবে। একজন মানুষের মাথা থেকে কীভাবে এতো দুষ্টু বুদ্ধি বের হতে পারে সেটা একটা রহস্য। শুরুতে যে দুষ্টুমির কথাগুলো বলা হয়েছে তার সবগুলোর নায়ক (কিংবা ভিলেন) হচ্ছে মিঠুন। একেবারে জন্মের পর থেকে সে দুষ্টু। ছোট বাচ্চার যখন জন্ম হয় তারা আস্তে আস্তে সবকিছু করতে শিখে। মিঠুন সবকিছু শিখেছে আগে আগে। যখন গড়াগড়ি দেওয়ার কথা তখন সে হামাগুড়ি দিয়েছে। যখন হামাগুড়ি দেওয়ার কথা তখন হাঁটাহাঁটি করেছে, যখন হাঁটাহাঁটি করার কথা তখন দৌড়াদৌড়ি করা শুরু করেছে। শুধু দৌড়াদৌড়ি করে শান্ত থাকলে একটা কথা ছিল সে একটা মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে বাসায় ঘুরে বেড়িয়েছে। তার প্রিয় কাজ ছিল টেবিলক্লথ ধরে টান দিয়ে টেবিলের সবকিছু নিচে ফেলে দেওয়া। এক মুহূর্তে চোখের আড়াল হলেই সে এরকম কিছু একটা অঘটন করে ফেলতো।
মিঠুনের আপু রাণী দাবী করেন মিঠুনের জন্মের আগেই বুঝে গিয়েছিলেন সে খুবই দুষ্টু একটা বাচ্চা হবে। পেটের ভেতরেই সে নাকি সারাক্ষণ এদিক সেদিক ঢুশঢাশ করত। জন্ম হবার পর যখন ন্যাপি বদলানোর সময় হতো তখন হিস্যু করে সবাইকে ভিজিয়ে দিয়ে সে মাঢ়ি বের করে হাসতো! যখন একটু বড় হয়েছে কেউ তাকে কোলে নিলেই সে খামচি দিয়ে মুখের চামড়া খাবলে নিত। চোখে চশমা থাকলে তো কথাই নেই খপ করে চশমাটা ধরে টান দিয়ে নাক থেকে খুলে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিত।
এখন স্কুলে ভর্তি হয়েছে, প্রায় প্রত্যেকদিন সেখান থেকে বাসায় একটা নালিশ আসে। নালিশের ধরনটাও বিচিত্র, সে যে শুধু দুষ্টুমি করছে তা না, ক্লাশের যতগুলো শান্ত শিষ্ট বাচ্চা ছিল তাদেরকেও দুষ্টুমি শিখিয়ে দিয়েছে এখন পুরো ক্লাস মিলে দুষ্টুমি করে! সেই দুষ্টু দলের লিডার হচ্ছে মিঠুন।
সেই তুলনায় বাসাতেই সে বরং একটুখানি শান্ত হয়ে থাকে। বাকি চার ভাই বোন মিলে তাকে মোটামুটি নিয়ন্ত্রণের মাঝে রাখতে পারে। মিঠুন জানে তার চার ভাই বোন তাকে শুধু যে সামলে রাখে তা নয় যখন কোনো বিপদের মাঝে পড়ে তখন তারাই তাকে সেই বিপদ থেকে রক্ষা করে।
সেদিন তার আব্দুর টেলিফোন বেজেছে, দেশে নূতন মোবাইল ফোন এসেছে সবারই সেটা নিয়ে কৌতূহল, সবচেয়ে বেশি কৌতূহল মিঠুনের। তার আলু বা আম্মু আশেপাশে নেই তাই সে লাফ দিয়ে টেলিফোনটা ধরে ফেলল, বলল, হ্যালো।
অন্য পাশ থেকে জিজ্ঞেস করল, ডক্টর মতিন বাসায় আছেন?
মিঠুন খুবই ভদ্রভাবে বলল, জী, বাসায় আছেন।
তার সাথে কী কথা বলা যাবে?
জী বলা যাবে।
তাকে টেলিফোনটা দিতে পারবে?
পারব।
ভেরি গুড।
মিঠুন টেলিফোনটা রেখে খেলতে চলে গেল। রাত্রে যখন মতিন মিঠুনকে জিজ্ঞেস করল কেন তাকে টেলিফোনটা দিল না মিঠুন দাঁত বের করে হেসে বলল, আমাকে দিতে বলে নাই আব্দু। আমাকে খালি জিজ্ঞেস করেছে দিতে পারব কী না। আমি বলেছি পারব। ভুল তো বলি নাই!
অকাট্য যুক্তি, সেই যুক্তি শুনে মিঠুনের বাবা পারলে নিজের চুল ছিঁড়ে ফেলেন। এই হচ্ছে আমাদের মিঠুন।
.
বাসার পাঁচজন ছেলে মেয়ের চার নম্বর হচ্ছে টিয়া। সে হচ্ছে রাহেলা খাতুনের বড় ছেলে মাসুদের ছোট মেয়ে। বয়সে সে দুষ্টু মিঠুন থেকে দুই বছর বড় এবং বিজ্ঞানী টিটন কিংবা মহাপুরুষ তিতুর থেকে দুই বছরের ছোট। তবে তাকে চোখ বুজে এই বাসার সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ বলা যায়। টিয়ার জন্ম হবার পর তার আম্মু কোনো একটা লেখায় পড়লেন যে ছোট বাচ্চাদের বই পড়ে শোনালে তারা নাকি নিজেরা নিজেরা পড়তে শিখে যায়। বিষয়টা সত্যি কিনা পরীক্ষা করার জন্য টিয়াকে তার আম্মু বই পড়ে শোনাতে শুরু করলেন এবং দেখা গেল টিয়া গভীর মনোযোগ দিয়ে বই পড়া শুনতে লাগল। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, টিয়ার যখন বয়স তিন বৎসর তখন সে বই পড়া শিখে গেল। টিয়াকে বই পড়তে দেখে মিঠুনের আম্মুও মিঠুনকে বই পড়ে শোনাতে চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু মিঠুন বই পড়ার থেকে বইয়ের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে সেটা মুখে ঢুকিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে বেশি আগ্রহ দেখানোর কারণে মিঠুনের আম্মু আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন!
চার বছর বয়সে টিয়া বাসায় ছোটদের সব বই পড়ে শেষ করে ফেলল। পাঁচ বছর বয়সে সে তার দাদি রাহেলা খাতুনকে ভোরবেলা পত্রিকা পড়ে শোনাতে লাগল। এখন তার বয়স দশ, সে এর মাঝেই এই বাসার পড়ার মতো সব বই পড়ে শেষ করে ফেলেছে, তার জন্যে এখন লাইব্রেরি থেকে বই আনতে হয়। টিয়া যে শুধু বড় বড় মোটা মোটা বই পড়ে তা নয় সে খুব তাড়াতাড়ি বই পড়তে পারে। সবাই একটা লাইনের সবগুলো শব্দ আলাদা আলাদা করে পড়ে কিন্তু টিয়া পুরো লাইনটা এক সাথে পড়ে। তাই সে যখন একটা বই পড়ে তখন দেখে মনে হয় সে বুঝি কিছু না পড়ে শুধু চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে। প্রথম প্রথম কেউ বিশ্বাস করতো না যে সে পড়ছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবাইকে বিশ্বাস করতে হয়েছে যে আসলেই সে পুরোটুকু খুবই মনোযোগ দিয়ে পড়ে।
মাত্র কিছুদিন আগে তাদের স্কুলে একজন নতুন ম্যাডাম এসেছেন। ক্লাশের ছেলে মেয়েদের ব্যস্ত রাখার জন্যে সবাইকে তাদের বইয়ের একটা গল্প পড়তে দিয়েছেন। সবাই যখন পড়ছে তখন টিয়া পড়া শেষ করে বইটা বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। ম্যাডাম ভুরু কুঁচকে টিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই মেয়ে আমি সবাইকে পড়তে বলেছি না?