.
তিতুর বয়স বারো এবং এই বাসায় ঠিক তিতুর বয়সী আরেকজন ছেলে আছে তার নাম টিটন। টিটন হচ্ছে রাহেলা খাতুনের বড় ছেলে, মাসুদের বড় ছেলে। টিটনের মাথায় চুল এলোমেলো এবং চেহারাটা ভাবুকের মতো। বেশিরভাগ সময় সে শান্ত হয়ে বসে থাকে, মনে হয় সে বুঝি কিছুই করছে না। কিন্তু কেউ যদি তার মাথায় ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখতে পারত তাহলে আবিষ্কার করতো সেটা মোটেও শান্ত হয়ে নাই, সেখানে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। হাজার রকম বৈজ্ঞানিক ভাবনা সেখানে কিলবিল কিলবিল করছে। মাঝে মাঝেই সেই সব বৈজ্ঞানিক ভাবনা কাজে লাগান হয়। কোনো কোনো সময় সেটা কেউ লক্ষ্য করে না আবার কোনো কোনো সময় সেটা একটা কেলেংকারি হয়ে যায়। এই বাসায় সবাই সবকিছু সহ্য করে বলে টিটন তার বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজ চালিয়ে যেতে পারছে অন্য যে কোনো বাসা হলে অনেক আগেই বিছানার নিচে এবং চারতলায় ছাদের বিভিন্ন কোনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তার ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি নালায় ফেলে দেয়া হতো।
যেমন ধরা যাক বাসার কাছে গাছের উপর ঝুলে থাকা মরা কাকটার কথা। একদিন দেখা গেল টিটন স্কুল থেকে আসার সময় হাতে একটা মরা কাক ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে বাসায় আসছে এবং রাজ্যের কাক তার পিছু পিছু কা কা করে চিৎকার করে সবার কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। দৃশ্যটি দেখে রাস্তার লোকজন বেশ অবাক হলেও এই বাসার কেউ সেরকম অবাক হলো না। তার মা জিজ্ঞেস করলেন এই কাক কই পেলি?
ডাস্টবিনে।
ও। কী করবি এটা দিয়ে?
গাছে ঝুলাব।
ও। যা, গাছে ঝুলিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে আয়।
টিটন তখন মরা কাকটা গাছে ঝুলিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে এল। গাছে ঝোলানোর কাজটা খুব সহজ হল না, অনেক কাক তাকে রীতিমতো আক্রমণ করার চেষ্টা করল। কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্যে টিটন সবরকম বাধা বিপত্তি সহ্য করতে রাজি আছে।
কাকের চিৎকারের কারণে পুরো দুই দিন এই এলাকার মানুষের প্রায় পাগল হয়ে যাবার অবস্থা হলো কিন্তু তারপর হঠাৎ করে সকল কাক এই এলাকা ছেড়ে অন্য কোনো জায়গায় দেশান্তরী হয়ে গেল।
বাসার পাশে খোলা জায়গাটার পোড়া দাগটার ইতিহাস অবশ্য মরা কাকের ইতিহাসের মতো এত নিরীহ নয়। একেবার ছোট বাচ্চাও জানে যে রকেট তৈরি করতে হলে তার জন্যে জ্বালানী দরকার, সেই জ্বালানি কীভাবে তৈরি করা যায় সেটা নিয়ে গবেষণা করা রীতিমতো সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই টিটন একটা শর্টকাট পদ্ধতি বেছে নিল। সে ঠিক করল, বিভিন্ন জিনিস মিশিয়ে সেখানে আগুন ধরিয়ে দেখবে সেটা রকেটের জ্বালানি হিসেবে কাজ করে কিনা। টিটন অনুমান করেছিল তার এই গবেষণাটা সবাই খুব সহজে মেনে নাও নিতে পারে। তাই যখন কেউ লক্ষ্য করছে না তখন রান্নাঘর থেকে লোহার কড়াইটা নিয়ে সে বাসার বাইরে চলে এল। সেখানে ছিল তিনশ একান্নটা ম্যাচের কাঠি, দেড় লিটার কেরোসিন, দুই চামুচ ভিনেগার, আব্বর আধ বোতল আফটার শেভ লোশন, আম্মুর সবচেয়ে পছন্দের একুশ ফোঁটা পারফিউম, ছয়টা ন্যাপথলিন, এগারোটা মোমবাতি, আধ লিটার পোড়া মোবিল, চারটা অ্যাসপিরিন এবং এক প্যাকেট সাদা গুড়ো- এই সাদা গুড়োটা টিটন রাস্তার পাশে খুঁজে পেয়েছে, ভিতরে কী আছে কেউ জানে না।
লোহার কড়াইয়ে সবকিছু ভালো করে ঘুঁটে ঠিক যখন আগুন লাগাবে তখন কোথা থেকে মিঠুন এসে হাজির হলো। মিঠুনের পরিচয় সময় মতো দেওয়া হবে। আপাতত বলে দেয়া যায় মানুষটা মিঠুন না হয়ে অন্য কেউ হলে জ্বালানীর এই গবেষণাটা অগ্রসর নাও হতে পারত, কিন্তু মিঠুনের প্রবল উৎসাহের কারণে টিটন সেখানে আগুন লাগিয়ে দিল। আগুনটা লাগতে চাইছিল না, প্রথমে ধিকি ধিকি করে জ্বলল, তারপর হঠাৎ করে আগুনটা ছড়িয়ে পড়ল। প্রথমে নীল রঙের একটা আগুন তারপর একটা ভয়াবহ বিস্ফোরণ করে দাউ দাউ করে সেই আগুন জ্বলে উঠল। কড়াই থেকে আগুনের গোলা এদিকে সেদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, একটুর জন্যে টিটন। আর মিঠুন বেঁচে গেল। আগুনের শিখা একেবারে বাসার ছাদ পর্যন্ত উঠে গেল তার সাথে কুচকুচে কালো ধোঁয়া। আশেপাশের কিছু গাছের গুঁড়িতেও আগুন লেগে গেল, এবং এই এলাকার লোকজন মজা দেখার ভিড় করে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। রাহেলা খাতুনের একেবারে ছোট ছেলে জয় ঘুমিয়েছিল, হৈ চৈ শুনে সে বের হয়ে দেখে চারিদিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। কী হচ্ছে বুঝতে একটু সময় লাগল। যখন বুঝতে পারল এটা টিটন এবং মিঠুনের আরো একটি কীর্তি তখন সে বাসার ভেতর থেকে বালতি ভর্তি করে পানি এনে কোনোভাবে আগুনটা নিভিয়ে দিল।
অন্য যে কোনো বাসা হলে এরপর টিটনের সব রকম গবেষণা বন্ধ হয়ে যেতো কিন্তু এই বাসায় তার গবেষণা বন্ধ হলো না। শুধুমাত্র নতুন একটা নিষেধাজ্ঞা জারি হলো যে যদি কখনো কোনো গবেষণায় আগুন জ্বালানোর দরকার হয় তাহলে আগে কোনো একজন বড় মানুষকে সেটা জানিয়ে রাখতে হবে।
.
টিটনের কথা বলার সময় যেহেতু মিঠুনের নামটি ব্যবহার করা হয়ে গেছে তাই বয়স অনুযায়ী সবচেয়ে ছোট হওয়ার পরেও তার কথাই আগে বলে নেয়া যাক। তার বয়স মাত্র আট এবং সে রাহেলা খাতুনের তিন নম্বর ছেলে মতিনের সন্তান। মতিন এবং তার স্ত্রী দুজনেই ডাক্তার এবং তাদের বিয়ের কিছুদিন পরেই তারা বুঝতে পারল স্বাভাবিকভাবে তাদের বাচ্চা হতে পারবে না। তারা হাল ছেড়ে না দিয়ে দেশ বিদেশ ঘুরে টেস্ট টিউব বেবী হিসেবে মিঠুনের জন্ম দিয়েছে। বাসার সবারই ধারণা টেস্ট টিউবে বেবী বড় করার সময়ে কোনো একটা গোলমাল হয়ে যাবার কারণে মিঠুন এতো দুষ্টু হিসেবে জন্ম নিয়েছে। এই বাসার একমাত্র বিজ্ঞানী টিটন সবাইকে বুঝিয়ে গেছে যদিও এরকম বাচ্চাদের টেস্টটিউব বেবী বলে কিন্তু তাদের মোটেও টেস্টটিউবে বড় করা হয় না, কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয় নাই। সবারই বদ্ধমূল ধারণা সে একটা ছোট ব্যাঙ্গাচির মতো টেস্টটিউবের ক্যামিকেলে সাঁতার কেটে কেটে বড় হয়েছে। মিঠুল নিজেও এটা বিশ্বাস করতে পছন্দ করে যে সে ছোট থাকতে একটা টেস্টটিউবের ভেতর ব্যাঙ্গাচির মতো সাঁতার কাটত।