প্রিন্সিপাল ম্যাডাম চশমার ফাঁক দিয়ে রিতুর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি ক্লাসে রাজ্জাক স্যারের সাথে বেয়াদপি করেছ?
পদার্থ বিজ্ঞান স্যার হচ্ছেন রাজ্জাক স্যার। রিতু বলল, না ম্যাডাম।
কিন্তু রাজ্জাক স্যার আমার কাছে তোমার নামে কমপ্লেন করেছেন। একজন স্যার যখন মনে করেন তার সাথে বেয়াদপি করা হয়েছে তখন বুঝতে হবে আসলে বেয়াদপি হয়েছে। বুঝেছ?
কিন্তু ম্যাডাম-।
এর মাঝে কোনো কিন্তু নেই। বুঝেছ?
আসলে কী হয়েছে আপনি শুনবেন না ম্যাডাম?
না। আমি শুনতে চাই না। তুমি রাজ্জাক স্যারের কাছে গিয়ে মাপ চাইবে। বুঝেছ?
রিতুর ভিতরে কেমন যেন সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। হঠাৎ করে সে মুখ তুলে বলল, না ম্যাডাম। আমি স্যারের কাছে এইটার জন্যে মাপ চাইতে পারব না।
ম্যাডাম ভুরু কুঁচকে রিতুর দিকে তাকালেন, শীতল গলায় বললেন, কী বললে?
রিতুর চোখে পানি চলে আসছিল, কিন্তু সে পানি আটকে রেখে বলল, যে স্যার মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে টিটকারী করেন আমি তার কাছে মাপ চাইতে পারব না। রিতু এক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, আমার নানা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
ম্যাডাম রিতুর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, রিতুর চোখে পানি চলে আসছিল তবুও সে চোখ নামাল না। একটু পরে বলল, আমি যাই ম্যাডাম?
যাও।
রিতু যখন দরজা পর্যন্ত গিয়েছে তখন প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ডাকলেন, বললেন, শোনো।
রিতু দাঁড়াল, ম্যাডাম বললেন, কাছে এসো।
রিতু ম্যাডামের কাছে এল। ম্যাডাম রিতুর হাত ধরে বললেন, আই এম সরি, আমি তোমার মনে কষ্ট দিয়েছি। আসলে সময়টা খুব খারাপ। বদরবাহিনীর দুইজন কমান্ডার এখন দেশের মন্ত্রী। সবাইকে এখন খুব সাবধান থাকতে হবে। আমরা সবাই এখন খুব বিপদে আছি। দুঃসময়ে টিকে থাকাটাই হচ্ছে বিজয়। বুঝেছ?
রিতু হাসল বলল, ম্যাডাম। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমরা যখন বড় হব, তখন সব রাজাকারকে ফিনিস করে দেব।
রিতুর কথা শুনে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম চোখ বড় বড় করে রিতুর দিকে তাকালেন। এই হচ্ছে আমাদের রিতু। যখন তেজ দেখালে বিপদ হতে পারে সেখানেও সে তেজ দেখায়।
.
রিতুর একজন ছোট ভাই আছে। রিতুর নামের সাথে মিল রেখে তার নাম রাখা হয়েছে তিতু, এই মিল ছাড়া দুইজনের ভেতর আর কোনো মিল নাই। রিতুর বয়স চৌদ্দ, তিতুর বারো। তিতুকে দেখলে অবশ্য মনে হয় তার বয়স আরো অনেক কম। রিতু যেরকম তেজী এবং জেদি এবং ছটফটে তিতু ঠিক সেরকম নরম এবং মোলায়েম এবং শান্ত। কেউ কখনো তাকে কোনো কিছু নিয়ে অস্থির কিংবা রাগ হতে দেখেনি। তার মুখে সবসময়েই একটা মিষ্টি হাসি, সবকিছু নিয়েই সে খুশি। সে কারো মনে কষ্ট দিতে পারে না, সেটি মানুষই হোক আর বিড়ালই হোক।
এই বাসার যতগুলো বিদখুটে প্রজেক্ট হাতে নেওয়া হয়েছে, শুধুমাত্র তিতু সেই প্রজেক্টগুলো নিয়ে একটু আপত্তি করেছে। এই বাসায় যে সবুজ এবং গোলাপি ছাগল দুটো ঘুরে বেড়ায় তারা যদি জানতো তাহলে তিতুর কাছে ছাগলগুলো আজীবন কৃতজ্ঞ থাকতো। কারণ তিতুর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার কারণে কোরবানী ঈদের আগের রাতে তারা প্রাণে বেঁচে গেছে। বাসার বিড়ালটাকে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতো রং করার আগেও তিতু বিড়ালটাকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু অন্য সবার প্রবল আগ্রহের কারণে বিড়ালটাকে এই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে। বাসার সামনে কুমির পালার জন্যে যে গর্ত করা হয়েছিল এবং যেখানে রাহেলা খাতুনকে কোনোকুনি কবর দেওয়ার আলোচনা হয়েছে সেটা তিতু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। যেদিন প্রথম এটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে তখনই সে সারাক্ষণ মাথা নেড়ে আপত্তি করে গেছে। সবাই চলে যাবার পর সে তার নানি রাহেলা খাতুনের কাছে গিয়ে একেবারে তার গলা জড়িয়ে ধরে ফিস ফিস করে বলেছে, মা।
রাহেলা খাতুন যদিও বাচ্চাদের নানি কিংবা দাদি কিন্তু বাচ্চারা মাঝে মাঝেই তাকে মা ডেকে ফেলে। রাহেলা খাতুন তিতুর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললেন কী হয়েছে সোনা।
তোমাকে যে কবর দেবে বলেছে সেটা তো সত্যি সত্যি বলেনি, তাই না মা?
রাহেলা খাতুন মুচকি হাসলেন বললেন, কিন্তু একদিন তো বুড়ি হয়ে মারা যেতেই হবে, কবর দিতেই হবে?
তিতু রাহেলা খাতুনের মুখে হাত দিয়ে বলল, না না না। তুমি মারা যাবে না, মা। তুমি কখনো মারা যাবে না।
রাহেলা খাতুন তিতুকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ঠিক আছে সোনা, আমি কখনো মারা যাব না।
সবাই যে বলেছে তোমাকে কোনাকুনি কবর দেবে সেটা কিন্তু ঠাট্টা করে বলেছে। বুঝেছ?
হ্যাঁ বুঝেছি।
আমরা কিন্তু কেউ আসলে তোমাকে মারা যেতে দেবো না। বুঝেছ মা? সবাই তোমার সাথে ঠাট্টা করেছে। কিন্তু মা, ঠাট্টা করেও এগুলো বলতে হয় না। এগুলো খুব খারাপ কথা।
ঠিক আছে সোনা।
তুমি মন খারাপ করো নাই তো? কেউ কিন্তু আসলে আসলে বলে নাই, সবাই ঠাট্টা করে বলেছে।
রাহেলা খাতুন হাসি গোপন করে মাথা নাড়লেন, বললেন, না, মন খারাপ করি নাই।
তুমি মন খারাপ করো না, প্লিজ। তাহলে আমারও অনেক মন খারাপ হবে।
ঠিক আছে আমি মন খারাপ করব না।
তিতু তখন আবার তার নানির গলা জড়িয়ে ধরল।
এই হচ্ছে তিতু। তিতুকে নিয়ে সবাই অল্পবিস্তর দুশ্চিন্তা করে, এরকম নরম একজন মানুষ, বড় হলে যখন চারপাশের সবগুলো মানুষ হবে ডাকাতের মতো তখন সে না জানি কোন ঝামেলায় পড়বে।