এমনিতে রাহেলা খাতুন খুবই হাসি খুশি মানুষ। কিন্তু আজকাল মাঝে মাঝেই মন খারাপ করে ফেলেন, কিছুতেই বুঝতে পারেন না এই দেশে কেমন করে রাজাকাররা মন্ত্রী হয়ে যাবে। তার ছেলে মেয়েরা এই বিষয়টা নিয়ে মায়ের সাথে কথা বলতে চায় না, বলার কিছু নাই সেটা হচ্ছে প্রধান কারণ। তবে তার নাতি নাতনিরা তাকে নানাভাবে ভরসা দিয়ে যাচ্ছে, তারা একেবারে কসম কেটে বলেছে একটু বড় হয়েই তারা দেশটাকে পরিষ্কার করে ফেলবে। কীভাবে কাজটা করা হবে সেটা নিয়ে কারোই কোনো ধারণা নাই কিন্তু সে জন্যে তাদের কোনো সমস্যা আছে বলে মনে হয় না।
রাহেলা খাতুনের পাঁচ নাতি নাতনির মাঝে সবচেয়ে বড় জনের নাম রিতু। তার বয়স এখন চৌদ্দ এবং সে ক্লাশ নাইনে পড়ে। আমাদের সাথে জমি দেখতে যাবার সময় মিলি নামে রাহেলা খাতুনের যে মেয়েটি পানিতে ডুবে গিয়েছিল রিতু তার বড় মেয়ে। এক কথায় রিতুর পরিচয় দিতে হলে বলা যায় সে হচ্ছে তার মায়ের মতো তেজী একজন মেয়ে। এই তেজের জন্যে মাঝে মাঝেই সে বড় বড় ঝামেলায় পড়ে যায় কিন্তু সেজন্যে তার তেজ কখনো কমে নাই, বরং বেড়েছে।
যেমন ধরা যাক কয়েকদিন আগে তাদের স্কুলের পদার্থবিজ্ঞান স্যারের কথা। এই স্যার নতুন এসেছেন, ক্লাশে পড়ানোর সাথে সাথে ছাত্রীদের নানারকম উপদেশ দেন, ঠিক কী কারণ জানা নেই উপদেশের সুরটা রিতুর বেশি পছন্দ না। সেদিন ক্লাসে এসে প্যাস্কেলের সূত্র পড়াতে পড়াতে থেমে গিয়ে দেশের কথা বলতে শুরু করলেন। গলা কাঁপিয়ে বললেন দেশ হচ্ছে দেশ মাতৃকা! আমাদের সবার দায়িত্ব হচ্ছে মায়ের সেবা করা, দেশও যেহেতু মা আমাদের সবার দেশের সেবা করতে হবে। বুঝেছ?
খুবই ভালো কথা তাই সবার সাথে সাথে রিতুও মাথা নাড়ল। প্যাস্কেলের সূত্র নিয়ে একটা প্রশ্ন রিতুর মাথায় মাঝে কুট কুট করছে কিন্তু যখন দেশ মাতৃকার কথা হচ্ছে সেখানে প্যাস্কেলের সূত্র নিয়ে কথা বলাটা ঠিক হবে না বলে রিতু চুপ করে রইল। কিন্তু স্যারের পরের কথাটা শুনেই তার ভুরু কুঁচকে উঠল। স্যার বললেন, দেশকে এগিয়ে নিতে হলে সবাইকে নিয়ে একসাথে এগিয়ে যেতে হয়। সকল রকম ভেদাভেদ ভুলে যেতে হয়। সেই কবে দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু তখন কে কী করেছিল সেটা নিয়ে এখনো দেশের মানুষের মাঝে বিভাজন, সেটা কী দেশের জন্যে মঙ্গল?
রিতু বলল, জী স্যার, মঙ্গল।
স্যার চমকে উঠলেন, এদিক সেদিক তাকিয়ে বললেন, কে? কে কথা বলেছে?
রিতু হাত তুলে বলল আমি স্যার।
স্যারের মুখটা কঠিন হয়ে উঠল, তুমি বলছ দেশের মানুষের মাঝে বিভাজন মঙ্গল?।
আমি বলতে চাইনি স্যার আমি আসলে প্যাস্কেলের সূত্র নিয়ে একটা প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু-
কিন্তু কী?
আপনি যেহেতু একটা প্রশ্ন করেছেন তাই বললাম।
তাই কী বললে?
রিতু এবার দাঁড়িয়ে গেল, বলল, আপনি ঠিক কী বলছেন পরিষ্কার বুঝি নাই। কিন্তু যদি রাজাকার আর মুক্তিযোদ্ধার কথা বলে থাকেন তাহলে বিভাজন তো থাকতেই হবে। রাজাকারদের বিচার করতে হবে স্যার। মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের বিচার করবে। বিচার করে ফাঁসি দিতে হবে। সবগুলোকে ফাঁসি দিতে হবে।
স্যারের মুখটা জানি কেমন হয়ে গেল, বললেন ফাঁ -ফাঁ- সি?
ক্লাশের বেশির ভাগ মেয়ে হঠাৎ কুট কুট করে হাসতে শুরু করল কয়েকজন টেবিলে থাবা দিয়ে শব্দ করল। স্যার ধমক দিয়ে বললেন, চোপ!
রিতু আগেও লক্ষ্য করেছে, শব্দটা হচ্ছে চুপ কিন্তু চুপ না বলে চোপ বলা হলে সেখানে অনেক বেশি জোর দেওয়া যায়। বেশি করে জোর দেওয়ার জন্য মেয়েরা সবাই চুপ করে গেল। স্যার বিষ দৃষ্টিতে রিতুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। কেউ সরাসরি তাকিয়ে থাকলে তার দিকে পাল্টা তাকিয়ে থাকা অস্বস্তির ব্যাপার, তাই রিতু এদিক সেদিক তাকাতে লাগল। একটু পরে বলল, প্যাস্কেলের সূত্রের প্রশ্নটা করব স্যার?
স্যার এবারে হুংকার দিলেন, চোপ। বেশি আঁতেল হয়েছ? আমারে মুক্তিযোদ্ধা শেখাও?
মুক্তিযোদ্ধা শব্দটা বলার সময় স্যার কেমন জানি মুখটা বিকৃত করে ফেললেন। রিতু কিছু না বলে বেশ শান্ত ভাবে চুপ করে রইল। সেটা দেখে স্যার মনে হয় আরো খেপে উঠলেন। জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী বেয়াদপ মেয়ে?
চুপ করে থাকাটা কীভাবে বেয়াদপি রিতু বুঝতে পারল না, কিন্তু সেটা নিয়ে সে মাথা ঘামাল না। সে নিজের নাম বলল এবং স্যার দাঁড়িয়ে কেমন জানি ফোঁস ফোঁস করতে লাগলেন। প্যাস্কেলের সূত্র নিয়ে প্রশ্নটা আর করা হলো না।
পরের পিরিওডে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম রিতুকে ডেকে পাঠালেন। রিতু বলল আজকে তার খবর আছে, কিন্তু সে সাহসে ভর করে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের ঘরে গেল। পর্দা ঠেলে যখন রিতু প্রিন্সিপাল ম্যাডামের বিশাল ঘরটায় ঢুকল তখন সেখানে আরো কয়েকজন স্যার আর ম্যাডাম বসেছিলেন। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি এই মেয়েটার সাথে একা কথা বলতে চাই, আমাকে দুই মিনিট সময় দিবেন?
সব স্যার, ম্যাডাম তখন ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে ছাত্রীরা যেরকম বাঘের মত ভয় পায় স্যার ম্যাডামরাও মনে হয় সেরকম ভয় পান। রিতু নিজেকে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করল, এখন তাকে খুব গুছিয়ে কথা বলতে হবে, তা না হলে বিপদ আছে।