রেগে একটা চড় দিতে যাচ্ছিলেন, আসাদ মেয়েটাকে টেনে সরিয়ে নিয়ে বললেন, আহা-হা-মারছ কেন?
মারব না তো মাথায় তুলে রাখব? আদর দিয়ে দিয়ে তুমি বাচ্চাগুলোকে নষ্ট করেছ।
আসাদ দুর্বল ভাবে হেসে বললেন, বাচ্চাদের আদর না করলে কাদের আদর করব?
সেদিন গভীর রাতে কাদামাখা অবস্থায় সবাই বাসায় ফিরে এসেছিলেন। রাহেলা খাতুন তার কাদামাখা সিল্কের শাড়িটা ধুয়ে পরিষ্কার করতে চেষ্টা করেছিলেন। খুব লাভ হয় নাই, তার সখের একমাত্র সিল্কের শাড়িটার রং উঠে বিতিকিচ্ছি হয়ে গিয়েছিল। আসাদ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন চিন্তা করো না রাহেলা। ঈদের বোনাসটা পেলেই তোমাকে নতুন একটা সিল্কের শাড়ি কিনে দেবো।
সেই শাড়ি আর কিনে দেয়া হয় নাই। তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে টানাটানির সংসার, দুই বেলা খাওয়ার জোগাড় করতেই হিমশিম অবস্থা সিল্কের শাড়ি কেনার সময় কোথায়? তার মাঝেই আসাদ তার সাত তালা বাড়ির স্বপ্ন দেখতেন। কীভাবে সেই বাড়ি হবে কেউ জানে না, কিন্তু স্বপ্ন দেখতে তো দোষ নেই। নিজের এক টুকরো জমি সেখানে নিজের একটা বাড়ি, সেটা কীভাবে কীভাবে জানি তার মাথায় মাঝে ঢুকে গেল।
.
নিজের জায়গা ব্যাপারটা আসাদ যে কতো গুরুত্ব দিয়ে নিয়েছিলেন সেটা বোঝা গেল একাত্তর সালে। যখন যুদ্ধ শুরু হলো তখন একদিন রাত্রে আসাদ বলল, বুঝলে রাহেলা, নিজের জায়গা না হলে জীবনের কোনো দাম নাই। সবার আগে দেশ স্বাধীন করতে হবে, তারপরে অন্য কথা।
রাহেলা খাতুন ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন করে দেশ স্বাধীন হবে?
যুদ্ধ করে।
রাহেলা খাতুনের বুক কেঁপে উঠল, যুদ্ধ করে?
হ্যাঁ।
কে যুদ্ধ করবে?
সবাই করবে। আমিও করব।
রাহেলা খাতুন ফ্যাকাসে মুখে বললেন, তুমি কেমন করে করবে? তুমি তো নিজে থেকে একটা মুরগিও জবাই করতে পার না।
আসাদ মুখ শক্ত করে বললেন, মুরগি জবাই করা এক জিনিস আর যুদ্ধ করা অন্য জিনিস।
রাহেলা খাতুন ফ্যাকাসে মুখে বললেন, তুমিও যুদ্ধে যাবে?
আসাদ মাথা নাড়লেন। রাহেলা খাতুন বললেন, আমাদের কী। হবে?
অন্য সবার যা হয় তোমাদের তাই হবে।
কিন্তু
কিন্তু কী?
রাহেলা খাতুন মাথা নিচু করে বললেন, আমার যে পেটে বাচ্চা।
আসাদের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, হাতে কিল দিয়ে বললেন, আমার একটা ছেলের জন্ম হবে স্বাধীন দেশে।
রাহেলা খাতুন অবাক হয়ে আসাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সেই আসাদ সত্যি সত্যি একদিন যুদ্ধে চলে গেলেন।
.
একদিন দেশ স্বাধীন হলো, একজন একজন করে সবাই ফিরে এল শুধু আসাদ ফিরে এলেন না। রাহেলা খাতুন ঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন, খুট করে শব্দ হলেই ছুটে যেতেন দেখার জন্যে, ভাবতেন আসাদ এসেছেন। আসাদ আর কোনো দিনই ফিরে এলেন না। মানুষটা একেবারেই হারিয়ে গেল, যেন আসাদ নামে এই পৃথিবীতে কেউ কখনো ছিল না।
রাহেলা খাতুনের আসাদের জন্যে যতটুকু দুঃখ হয়েছিল তার থেকে অভিমান হয়েছিল অনেক বেশি, কেন মানুষটা তাকে এভাবে একা ফেলে রেখে চলে গেল? কেন কোনোদিন ফিরে এল না?
একদিন ছোট ছেলেটার জন্ম হলো, আসাদ যেরকম কল্পনা করেছিলেন ঠিক সেরকম স্বাধীন একটা দেশে। দেশটা স্বাধীন কিন্তু সেই দেশে বেঁচে থাকা খুব কঠিন। নূতন বাচ্চাটার নাম রেখেছেন জয়, ফুটফুটে একটা বাচ্চা কিন্তু তার মুখের দিকে তাকানোর সময় পান না। চারটা ছোট ছোট বাচ্চাকে নিয়ে বেঁচে থাকার জন্যে রাহেলা খাতুন যুদ্ধ শুরু করলেন। যে বাসায় থাকতেন সেই বাসাটা ছেড়ে বস্তির মতো একটা জায়গায় উঠে এলেন। এক ঘরে সবাই গাদাগাদি করে থাকেন বড় ছেলেটা মাঝে মাঝে বলে মা, লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে টেম্পোর হেলপার হয়ে যাই।
রাহেলা খাতুন বলতেন, খবরদার। তোর বাপ তোদের টেম্পোর হেলপার হওয়ার জন্যে জন্ম দেয় নাই।
রাহেলা খাতুন তার হাতের গয়না একটা একটা করে বিক্রি করে দিলেন। পুরানো একটা সেলাইয়ের মেশিন কিনলেন। দিনরাত সেটা দিয়ে ঘটর ঘটর করে কাপড় সেলাই করতেন। তখন কাপড়ের কী অভাব, তিনি খুঁজে পেতে ছোট ছোট কাপড়ের টুকরো জোগাড় করতেন, সেগুলো জোড়া দিয়ে শার্ট বানাতেন, জামা বানাতেন। সেগুলো বিক্রি করতেন। সবাই কম কম করে খেত, তিনি খেতেন আরো কম। কত রাত গিয়েছে যখন রাহেলা খাতুন শুধু এক গ্লাশ পানি খেয়ে শুয়ে পড়েছেন। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্যে সবকিছু বিক্রি করে দিয়েছিলেন- শুধু একটা জিনিস বিক্রি করেন নাই। সেইটা হচ্ছে সাতফুট পানির নিচে ডুবে থাকা জমিটা। সেই জমির দলিলটা একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটের মাঝে রাখতেন, পোকায় না কেটে ফেলে সেজন্যে সেখানেই দুইটা ন্যাপথলিন রাখতেন। মাঝে মাঝে খুলে দেখতেন দলিলটা ঠিক আছে কী না।
.
একদিন ছেলে মেয়েরা বড় হলো। রাহেলা খাতুন নিজে কিংবা আসাদ যেটা করতে পারেন নাই তার ছেলেমেয়েরা সেইটা করলো। মাটি দিয়ে জমি ভরাট হলো। আসাদ যেটুকু জমি কিনেছিল তার পাশে আরো খানিকটা জমি কেনা হলো। জমিটার একপাশে সাত তালার জায়গায় চারতলা একটা বাসা হলো। নিচ তালাটা রাখা হলো রাহেলা খাতুনের জন্যে। ছোট ছেলে জয় এখনো বিয়ে করেনি (কিন্তু বিয়ে হয়ে যাবে হয়ে যাবে এরকম একটা আভাষ আছে), সে থাকে রাহেলা খাতুনের সাথে। উপরের তিনটা ফ্ল্যাটে রাহেলা খাতুনের তিন ছেলে মেয়ে থাকে। চার তলার ছাদে আরেকটা ফ্ল্যাট তৈরি হওয়ার কাজ শুরু হয়ে থেমে গেছে সেখানে একটা বড় খালি রুম এই বাসার পাঁচ নাতি নাত্নির দখলে। রাহেলা খাতুনের চার ছেলেমেয়ের তিন বউ জামাই মিলে সাতজন, নাতি নাত্নি পাঁচজন, এই নিয়ে এক ডজন। রাহেলা খাতুনকে নিয়ে হলো এক ডজন একজন। এই নিয়ে এক ডজন একজন কাহিনীর শুরু হয়েছে এখান থেকে।
০২. যখন পাঁচ নাতি-নাত্নী
সময়টা হচ্ছে ২০০৫ সালের মাঝামাঝি। প্রত্যেকদিন সকালে জোবেদা খাতুন পত্রিকাটা খুলেই ওয়াক থু! ওয়াক থু! করে চেঁচামেচি শুরু করেন। তার স্বামী আসাদ রহমান এই দেশটার জন্যে যুদ্ধ করে মরেই গেছেন, শুধু যে মরে গেছেন তাই না একেবারে হারিয়েই গেছেন মানুষটা, মাটি পেয়েছেন কী না সেইটাও কেউ জানে না। সেই দেশে দুইজন রাজাকার এখন মন্ত্রী, পত্রিকায় তাদের ছবি ছাপা হলে রাহেলা খাতুন ওয়াক থু। বলতেই পারেন।