ইদরিস মিয়া নামের মানুষটা এবারে নদী থেকে চোখ ফিরিয়ে ওদের দিকে তাকালো। রিতু বলল, আমার নানার নাম ছিল আসাদ রহমান।
ছেলেমেয়েরা সবাই দেখতে পেলো ইদরিস মিয়ার পুরো শরীরটা কেমন যেন ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। রিতু শান্ত গলায় বলতে লাগল, আমার নানা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর আমার নানা কখনো ফিরে আসেন নাই। আমরা কেউ জানি না আমার নানার কী হয়েছে।
হঠাৎ করে মনে হলো ইদরিস মিয়ার শরীরটা অল্প অল্প কাঁপতে শুরু করেছে। রিতু একটু অবাক হলেও কথা থামাল না, বলতে থাকল, আমরা জানতে পেরেছি আমার নানা আসাদ রহমান এই এলাকায় যুদ্ধ করেছিলেন। আপনিও এই এলাকায় যুদ্ধ করেছেন। আমরা তাই আপনার কাছে জানতে এসেছি, আপনি কী যুদ্ধের সময় আমার নানাকে কখনো দেখেছেন, নানার কী হয়েছে আপনি জানেন?
ছেলেমেয়েরা অবাক হয়ে দেখল, ইদরিস মিয়ার সমস্ত শরীর কাঁপছে, তার দুই চোখ পানিতে ভরে উঠেছে। মানুষটা নিজের ঠোঁট কামড়ে তার চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা করছে। পারছে না।
তিতু সামনে এগিয়ে মানুষটার হাত ধরে ফেলল, বলল, আপনি আমার নানাকে চিনেন? নানার কী হয়েছে আপনি জানেন। তাই না? তাই না?
মানুষটার চোখ থেকে ঝর ঝর করে পানি ঝরতে থাকে। ইদরিস মিয়া ভাঙা গলায় বলল, হ্যাঁ। আমি চিনি। আমি চৌত্রিশ বছর থেকে আসাদ ভাইয়ের কবরটা পাহারা দিচ্ছি। তোমাদের জন্য।
টিটন বলল, আমার দাদার কবরটা কোথায় আপনি জানেন? আপনি জানেন?
হ্যাঁ জানি। ইদরিস মিয়া একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, তোমাদের দাদা, আসাদ ভাই মারা যাওয়ার পর তার পকেটে আমি একটা ফাটো আর একটা চিঠি পেয়েছিলাম। সেই চিঠি কাকে দিব আমি জানি না। তাই আমি তোমাদের দাদার কবরের কাছে বসে আছি। আমি জানি একদিন না একদিন তোমরা আসবে।
তিতু জিজ্ঞেস করল, আছে সেই চিঠিটা আপনার কাছে। হ্যাঁ, আছে। তোমাদের দিব।
টিয়া বলল, দাদার কবরটা দেখাবেন আমাদের?
দেখাব। আস আমার সাথে।
ইদরিস মিয়া উঠে দাঁড়ালেন। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে থাকেন। মিঠুন গিয়ে তার হাত ধরে বলল, আমরা কী আপনাকে দাদু ডাকতে পারি?
মানুষটা মিঠুনের দিকে তাকালো, তার মাথায় হাত রাখল, তারপর বলল, হ্যাঁ ভাই। তুমি আমারে দাদু ডাকতে পার। তোমার দাদু আমার মায়ের পেটের ভাই থেকেও বড় ভাই ছিল।
ইদরিস মিয়া ছেলেমেয়েদের নিয়ে জঙ্গলের মতো জায়গাটাতে ঢুকলেন, গাছপালার ভেতর দিয়ে ছোট একটা হাঁটা পথ। হেঁটে হেঁটে খানিকদূর যেতেই জঙ্গলটা একটু হালকা হয়ে গেল, তারপর বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। ফাঁকা জায়গাটায় নানা রকম ঝোঁপঝাড়। তার মাঝে খানিকটা জায়গা কেউ যেন ঝেড়ে মুছে রেখেছে। একটা বকুল ফুলের গাছ তার নিচে ঘন সবুজ ঘাসের একটা গালিচা। কেউ বলে দেয়নি কিন্তু তারা সবাই বুঝে গেল এটাই আসাদ রহমানের কবর। তাদের দাদার কবর। তাদের নানান কবর।
ইদরিস মিয়া কবরটার পাশে উবু হয়ে বসে সেখানে হাত রেখে ফিসফিস করে বলল, ভাইজান। আপনার নাতি নাতনিরা আপনারে দেখতে আসছে। আমি আপনারে বলছিলাম না, একদিন আসবেই না আসব? রিতু দেখল বোকা তিতুটা ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করেছে। তার না হয় মনটা নরম, সে কাঁদতেই পারে। কিন্তু অন্যদের চোখও কেন ঝাপসা হয়ে আসছে?
১২. যখন যুদ্ধের গল্প
১২. যখন ইদরিস মিয়ার কাছ থেকে সবাই যুদ্ধের গল্প শুনেছে।
ইদরিস মিয়ার চালাঘরের সামনে ছোট একটা আগুন জ্বলছে। সবাই আগুনটাকে ঘিরে বসেছে। আগুনের শিখা লকলক করছে, তার লালাভ আলোতে সবাইকে কেমন জানি অবাস্তব দেখায়। মিঠুন একটা কাঠি দিয়ে একটু পর পর জ্বলন্ত কাঠকুটোতে খোঁচা দিচ্ছে এবং তখন আগুনের ফুলকি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।
ইদরিস মিয়া একটু উবু হয়ে বসেছে, আগুনের জ্বলন্ত শিখায় তার এলোমেলো চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি গোঁফ আর মুখে। বয়সের ছাপ যেন আরো অনেক বছর বেড়ে গেছে। দূর থেকে ভেসে আসা নদীর ঢেউয়ের শব্দ, এলোমেলো বাতাস আর আগুনের শিখার শব্দের মাঝে ইদরিস মিয়া আসাদ রহমানের জীবনের শেষ কয়টা দিনের কথা বলছে। সবাই নিশ্বাস বন্ধ করে সেই অবিশ্বাস্য দিনগুলোর কথা শুনছে।
ইদরিস মিয়া বলছে, এই এলাকায় তখন পাকিস্তানি মিলিটারির খুব উৎপাত। ওরা বাংকারে থাকে। বাংকারগুলো অনেক শক্ত। প্রথম আস্তরে মাটি আর টিনের দেওয়াল। তারপর ছয় ইঞ্চি পরপর লোহার বিম, সেইখানে কংক্রিটের আস্তর। বাংকারের কাছে কেউ যেন যেতে না পারে সেইজন্য সামনে মাইন, বুট্র্যিাপ আর বাঁশের কঞ্চি।
পাকিস্তানিরা দিনের বেলা অনেক এলাকা মিলিয়ে ডিফেন্স নিয়ে থাকতো। রাতের বেলা দূরের বাংকারগুলো ছেড়ে সেকেন্ড লাইন অফ ডিফেন্সে চলে যেত। সেকেন্ড লাইন অফ ডিফেন্স ঘন, অনেক কাছাকাছি। সেখানে অনেকগুলো ভারী মেশিন গান সবসময় রেডি থাকে।
আমাদের কুড়ি জনের একটা দল তৈরি হয়েছে। এইটা একটা স্পেশাল প্লাটুন। আমাদের কাজ হচ্ছে সবসময় পাকিস্তানিদের আশেপাশে থাকা আর সুযোগ পেলেই তাদের ওপর একটা হামলা করা। সারাক্ষণ ওদের ওপর হামলা করার জন্য ওরা ব্যস্ত থাকে, মনের দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন যখন রেগুলার বাহিনী সামনাসামনি আক্রমণ করে ওরা সহজে ঘায়েল হয়ে যায়।
আসাদ ভাই আমাদের দলটার কমান্ডার। অসম্ভব সাহসী মানুষ। একেবারে সিংহের মতো সাহস।