হাঁটতে হাঁটতে রিতু বলল,আমরা কী বাঁচা বেঁচে গেছি। যদি মিঠুন না হলে টিটুনের কিছু একটা হতো তাহলে আমাদের কী হতো।
টিটন বলল, কী আর হতো? ওরা ভয় দেখাবে চাইছিল আমরা ভয় পেতাম।
তিতু বলল, আমি অনেক ভয় পেয়েছি।
টিয়া বলল, আমিও।
মিঠুন বলল, আমি একটুও ভয় পাই নাই।
রিতু হাসল, বলল এই প্রথম দুষ্টু হওয়ার একটা উপকারিতা দেখতে পেলাম, যখন ভয়ের ব্যাপার হয় তখনও ভয় পায় না।
রিতুর কথা শুনে মিঠুন দাঁত বের করে হি হি করে হাসল।
১আরো মিনিট ত্রিশেক হাঁটার পর ইব্রাহীম চাচা বলল, আমরা এসে গেছি।
এসে গেছি?
ইব্রাহীম চাচা উত্তর দিল না। ইব্রাহিম চাচা তার আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। দরকার না হলে এখন আর একটা কথাও বলবে না।
ইব্রাহীম চাচা আরো খানিকদূর হেঁটে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল। তারপর একটু দূরে একটা ঝপড়া গাছ দেখিয়ে বলল, গাছের নিচে একটা চালাঘর দেখেছ? ইদরিস মিয়া এখানে থাকেন।
ইব্রাহীম চাচা এটাকে চালাঘর বলছে কিন্তু এটা চালাও না ঘরও না। কার্ডবোর্ডের বাক্স, পলিথিনের ব্যাগ, কাঠ-কুটো, বাঁশের কঞ্চি এইসব দিয়ে কোনোমতে একটা কিছু দাঁড় করানো হয়েছে। বৃষ্টি হলে সরাসরি মাথায় বৃষ্টি পড়বে না, এছাড়া এই চালাঘরটির আর কোনো কাজে আসার কথা না। চালাঘরটির নিচে একটা বিছানা, কয়েকটা হাঁড়িকুড়ি। একটি দড়ি থেকে একটা লুঙ্গি এবং একটা রং ওঠা পাঞ্জাবী ঝুলছে। জায়গাটা নির্জন এবং ফাঁকা। আশে পাশে কেউ নেই।
রিতু জিজ্ঞেস করল উনি কোথায়?
ইব্রাহীম কোনো উত্তর দিল না। টিটন বলল, আমরা তো আর অ্যাপয়ন্টমেন্ট করে আসি নাই। উনাকে থাকতে হবে কে বলেছে?
রিতু মাথা নাড়ল বলল, তা ঠিক।
তিতু বলল, আমরা অপেক্ষা করি। জায়গাটা কী সুন্দর।
মিঠুন নিজের ঘাড়ে থাবা দিয়ে একটা মশা মেরে বলল, খালি মশাগুলো একটু রাজাকার টাইপ!
টিটন বলল, মশাকে দোষ দিবি না। মা মশাদের বাচ্চা জন্ম দেওয়ায় জন্য রক্ত খেতে হয়। কাজেই যতবার একটা মশা মারবি জেনে রাখিস তুই একটা মাতৃহন্তা।
রিতু বলল, হয়েছে। এখন মশার জন্য দালালি করতে হবে না।
ঠিক এই সময় ইব্রাহীম বলল, ঐযে, ইদরিস মিয়া আসছেন।
কোথায়? কোথায়?
ইব্রাহিম নিশ্চয়ই কথার উত্তর দিবে না তাই সবাই এদিক সেদিক তাকাতে থাকে। তখন দেখল পিছনে জঙ্গলের ভিতর থেকে একজন লম্বা মানুষ হেঁটে হেঁটে আসছে। মানুষটা এমনভাবে হাঁটছে যে দেখে মনে হয় সে বুঝি মাটিতে পা দিয়ে হাঁটছে না শূন্যের উপর ভাসতে ভাসতে আসছে। শুধু তাই না মানুষটাকে দেখে মনে হয় তার চারপাশে কী হচ্ছে সে কিছুই জানে না।
মিঠুন সবার আগে এবং তার পিছু পিছু অন্য সবাই মানুষটার দিকে এগিয়ে গেল। মানুষটা কাউকে দেখল বলে মনে হলো না। সে অনেকটা আপন মনে হেঁটে হেঁটে তার বিচিত্র চালাঘরটার নিচে গিয়ে বিছানাটা টেনে বিছিয়ে দিল। একটা চাটাইয়ের উপর একটা কথা তার ওপর একটা তেল চিটচিটে বালিশ। মানুষটা সেখানে পিঠ সোজা করে বসল যেন সে কোনো একটা ধ্যান করতে বসেছে।
বাচ্চারা কাছাকাছি গিয়ে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। মানুষটা তাদের দিকে তাকায় কিন্তু তাদের দেখছে কী না সেটা বোঝা গেল না। রিতু গলা পরিষ্কার করে বলল, আমরা ঢাকা থেকে এসেছি।
মানুষটা হ্যাঁ না কিছু বলল না, তাদের দিকে এক ধরনের শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রিতু বলল, আমরা সবাই ভাইবোন। কাজিন বলতে পারেন।
মানুষটা এবারেও কিছু বলল না। রিতু বলল, আপনি নিশ্চয়ই ইদরিস মিয়া, মুক্তিযোদ্ধা?
এবারে মানুষটা একটু ভুরু কুঁচকে, তারপর শুকনো গলায় বলল তোমাদের কোনো একটা ভুল হয়েছে। আমি কেউ না।
তিতু অবাক হয়ে বলল, কেউ না?
মিঠুন হি হি করে হাসল, বলল, কেউ না কখনো হয় না। হাত দিয়ে ইদরিস মিয়াকে দেখিয়ে বলল, এই যে আপনি কেউ।
টিটন পিছন থেকে মিঠুনের কাঁধে ধরে একটা ছোট ধাক্কা দিয়ে বলল, মিঠুন, তুই চুপ করবি?
মিঠুন চুপ করল। রিতু বলল, আমরা ঢাকা থেকে এসেছি। আমরা আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাই।
মানুষটা বিচিত্র একটা দৃষ্টিতে রিতুর দিকে তাকিয়ে রইল, যখন মনে হলো কিছু বলবে না তখন হঠাৎ করে বলল, আমি কারো সাথে কথা টথা বলি না। তোমরা অন্য কোনোখানে যাও।
তিতু বলল, কিন্তু আমরা তো আপনার সাথেই কথা বলতে চাই। অন্য কারো সাথে না।
মানুষটা তিতুর কথার উত্তর দিল না। এতক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়েছিল এবারে একটা নিশ্বাস ফেলে দূরে নদীর দিকে তাকিয়ে রইল। বোঝাই যাচ্ছে সে আর কথা বলবে না।
টিয়া প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আপনি আমাদের সাথে কথা বলবেন না?
মানুষটা কোনো কথা না বলে স্থির দৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে রইল। ইব্রাহীম চাচা কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল, এবারে সে বলল, উনি আজকে মনে হয় কথা বলতে চাচ্ছেন না। চল, আমরা যাই।
রিতু বলল, আপনি যান। আমরা আর কিছুক্ষণ থাকি।
ইব্রাহীম চাচা বলল, উনাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না।
রিতু বলল, আমরা বিরক্ত করব না। আমরা একটু বসে থাকি। আপনি যান।
ঠিক আছে। আমি অপেক্ষা করি। বলে ইব্রাহীম চাচা হেঁটে হেঁটে নদীর দিকে এগিয়ে গেল। ইব্রাহীম চাচা বেশ খানিকটা দূরে যাবার পর রিতু ইদরিস মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে, আপনি যদি শুধু আমাদের কথা একটু শুনেন।