যাই হোক মানুষগুলো তাদেরকে আজহার আলীর মহাজনী নৌকায় তুলেছে, তাদের হাত বেঁধে পাটাতনের নিচে রেখে নেমে গেছে। মানুষগুলো নৌকা থেকে নামার আগেই মিঠুন তার হাত পায়ের বাঁধন খুলে ফেলেছিল। মিঠুন কীভাবে সেটা করেছে সেটা সবাইকে করে দেখালো। মানুষগুলো যখন তাকে বাঁধে তখনই সে তাদেরকে শক্ত করে বাঁধতে দেয় নাই, হাত পা গুলো জোর করে ছড়িয়ে রেখেছে, যখনই বাঁধতে চেষ্টা করেছে সে অনেক জোরে চিৎকার করেছে। মানুষগুলো ধারণা করেছে তারা এত জোরে বেঁধেছে যে ব্যথায় চিৎকার করছে।
মানুষগুলো চলে যাবার পর সে প্রথমে একটা হাত ছুটিয়ে এনেছে, সেটা দিয়ে হাতের বাঁধন খুলেছে, তারপর পায়ের বাঁধন খুলেছে। মিঠুন নিজেকে ছোটানোর পর টিটনকে ছুটিয়েছে তারপর মাথার উপর ঢেকে রাখা কাঠ সরিয়ে পাটাতন থেকে বের হয়ে এসেছে। পাটাতন থেকে বের হয়ে দুইজন মিলে নৌকাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে। নৌকাটা চিনির বস্তা দিয়ে বোঝাই। ছইয়ের কাছে একটা চাটাই দিয়ে ঢাকা একটা জায়গায় একটা বন্দুক এবং কয়েকটা কার্তুজ খুঁজে পেয়েছে। মিঠুন বন্দুকে একটা কার্তুজ ঢুকিয়ে আকাশের দিকে একটা ফাঁকা গুলি করতে চেয়েছে কিন্তু টিটন তাকে সেটা করতে দেয় নাই।
নৌকার ভিতরে অনেক রকম জঙ্গিদের বই ছিল, বেশ কয়েকটা দা এবং চাইনিজ কুড়াল। কাগজপত্র এবং চিঠি, চিঠিতে অনেক বানান ভুল সেইজন্য তারা পড়ার আগ্রহ দেখায় নাই। নৌকায় মাঝে লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, গামছা এইরকম কিছু কাপড় জামা এবং একটা লম্বা নল লাগানো হুঁকো খুঁজে পেয়েছে। কোটা দেখে মিঠুনের কিছু মনে হয় নাই কিন্তু টিটন আনন্দে লাফাতে লাগল। সে নাকী হুঁকোর লম্বা নল দিয়ে কীভাবে এই মহাজনী নৌকাটা ডুবিয়ে দেবে।
মিঠুন মোটেও টিটনের কথা বিশ্বাস করে নাই কিন্তু সত্যি সত্যি হুঁকোর নলটা পানিতে ভরে নদীতে এক মাথা আর নৌকার ভিতরে আরেক মাথা রেখে টিটন কী যেন করে ফেলল তখন নদীর পানি নৌকার ভিতর এসে পড়তে নাগল।
(গল্পের এই জায়গায় টিটন সবাইকে বলল, এইভাবে উঁচু জায়গা থেকে নিচু জায়গায় পানি ফেলার পদ্ধতির নাম সাইফন এবং সাইফন কীভাবে কাজ করে সে সেইটাও বোঝানোর জন্যে রেডি ছিল কিন্তু যারা শুনছে তাদের কারোই বিজ্ঞান নিয়ে কোনো আগ্রহ ছিল না বলে সেটা সে বোঝানোর সুযোগ পেল না।)।
নৌকাটা অনেক বড় এবং কোর নল দিয়ে অল্প করে পানি এসে ঢুকছে, কাজেই পুরো নৌকাটা পানিতে ভরে ডুবে যেতে একটু সময় নেবে। টিটনের কোনো তাড়াহুড়ো ছিল না, এতক্ষণে নিশ্চয়ই নৌকাটা ডুবে গেছে। তবে নৌকাটা ডুবে গেলে নৌকাতে রাখা চিনির বস্তাগুলো যখন নদীর পানিতে গলে যাবে তখন পুরো নদীর পানি নিশ্চয়ই মিষ্টি হয়ে যাবে। আজহার আলীর নিশ্চয়ই অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে কিন্তু এগুলো নাকী চোরাচালানি করে আনা চিনি, এভাবেই এগুলোর নদীর পানিতে গলে যাওয়াই উচিৎ।
মহাজনী নৌকাটা প্রায় নদীর মাঝখানে নোঙর করে রেখেছিল। সেখান থেকে তীরে আসতে তাদের খুব বেশি ঝামেলা হয় নাই। নদীতে অনেক নৌকা চলাচল করে তাদের হাত তুলে ডেকে অনুরোধ করতেই তাদের তীরে নামিয়ে দিয়েছে। তারা টাকা দিয়ে নৌকার ভাড়া দিতে পারে নাই তবে টাকার বদলে মাঝিকে দুই গামলা চিনি দিয়েছে।
তীরে এসে একটু খোঁজখবর করতেই একজন জানিয়েছে রিতু তিতু আর টিয়া মাস্টার সাহেবের সাথে আজহার আলীর বাড়িতে গেছে তখন একজন তাদেরকে আজহার আলীর বাড়ি নিয়ে গেছে।
মিঠুনের খুব সখ ছিল, বন্দুকটা যেহেতু সে খুঁজে পেয়েছে সে এটা নিজের কাছে রেখে দেবে। কিন্তু মাস্টার সাহেব রাজী হন নাই। বন্দুকটা মিঠুনের হাত থেকে নিয়ে থানায় পাঠিয়ে দিয়েছেন।
টিটন আর মিঠুন কিডন্যাপ হয়েছে আবার ছাড়াও পেয়েছে, আজহার আলী অনেক বিপদের মাঝে আছে, মতি আর খলিল রীতিমতো গ্রামের মানুষের পা ধরে কান্নাকাটি করছে, আজহার আলীর চোরাচালানি করে আনা চিনি বোঝাই মহাজনী নৌকা নদীতে ডুবে গেছে, নদীর পানি সরবতের মতো মিষ্টি, এক কথায় বলা যেতে পারে সবকিছু একেবারে ম্যাজিকের মতো ঘটে যাচ্ছে। আনন্দ এবং উত্তেজনায় সবাই প্রায় ভুলেই গিয়েছিল যে তারা এখানে এসেছে ইদরিস মিয়াকে খুঁজে বের করে তার সাথে কথা বলতে। সকালবেলা গেস্টহাউজ থেকে বের হয়েছে ইদরিস মিয়ার সাথে দেখা করতে, এখন দুপুর গড়িয়ে গেছে।
তিতু সবার আগে অন্যদের সেটা মনে করিয়ে দিল। মিঠুন যখন রংচং চড়িয়ে তার গল্পটা আবার শুরু করতে যাচ্ছিল তখন তিতু ইব্রাহীম চাচাকে বলল, ইব্রাহীম চাচা আমরা মুক্তিযোদ্ধা ইদরিস মিয়ার সাথে কথা বলতে যাব না?
ইব্রাহীম চাচা বলল, তোমরা যদি যেতে চাও। আজকে এতো কিছু হয়েছে।
সবাই একসাথে বলল, যাব। যাব। আমরা যাব। এখনই যাব। শুধু তাই না যাওয়ার জন্য কয়েকজন লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর মাস্টার সাহেবের বাসায় মানুষজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তারা ইসদিও মিয়ার খোঁজে রওনা দেয়।
.
ইব্রাহীম চাচা এবারে সবাইকে নিয়ে নদীর তীর ঘেঁষে হাঁটতে লাগল। সবাই আজহার আলীর নৌকাটা কোথায় ছিল দেখতে চাইছিল। কিন্তু তখন সেখানে কিছু নাই, নৌকার মাস্তুলটা চেষ্টা করলে একটুখানি দেখা যায়। নদীর তীরে ঠিক হাঁটার রাস্তা নেই। জায়গাটা উঁচু নিচু, মাঝে মাঝে ছোট খাল, গাছপালা, ঝোঁপঝাড়। মাঝে মাঝে গরু ছাগল উদাস মুখে দাঁড়িয়ে আছে না হয় মনোযোগ দিয়ে ঘাস খাচ্ছে। নদীর তীরে ছোট ছোট গ্রাম, সেখান থেকে মহিলারা থালাবাসন কাপড় নিয়ে নদীর দিকে যাচ্ছে না হয়, নদী থেকে ফিরে আসছে। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা নদীর পানিতে লাফালাফি করছে। তাদের আনন্দ দেখে সবারই মনে হলো তারাও যেন পানিতে গিয়ে লাফিয়ে পড়ে!