পাশের গ্রামের মানুষটা চিঠি এবং একটা লজেন্স নিয়ে চলে যাবার পর মতি আর খলিল টিটন এবং মিঠুনকে নিয়ে রওনা হলো। জংগলের ভিতর দিয়ে নদীর তীরে এসে ছোট একটা নৌকাতে মতি প্রথমে মিঠুনকে তুলে রওনা দিল। তাকে বলা হয়েছে সে যদি একটু চিৎকার করে সাথে সাথে টিটনের একটা বুড়ো আঙুল কেটে ফেলা হবে। টিটনের বুড়ো আঙুলের জন্যে মায়া করে মিঠুন চুপচাপ রইল। তা নাহলে সে মোটেও চুপ করে থাকার মানুষ না। মিঠুনকে আজহার আলীর মহাজনী নৌকায় শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে মতি নৌকা নিয়ে ফিরে এল, টিটনকে নৌকায় নিয়ে যাওয়া মোটামুটি সহজ হলো, তাকে ভয় দেখানো হলো একটু খানি শব্দ করা হলে মহাজনী নৌকায় মিঠুনের একটা আঙ্গুল কোপ দিয়ে কেটে ফেলা হবে। যদি কোনো গোলমাল না করে চুপচাপ বসে থাকে তাহলে ঘণ্টাখানেকের মাঝে তাদের দুজনকে ছেড়ে দেওয়া হবে এবং তখন সবাই মিলে ঢাকা চলে যেতে পারবে।
মহাজনী নৌকাতে দুইজনকে শক্ত দড়িতে বেঁধে পাটাতনের নিচে শুইয়ে রাখল। মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে রেখেছে যেন চিৎকার করতে না পারে। তারপর মতি আর খলিল ছোট নৌকাটাতে করে তীরে নেমে গেল।
যখন মতি বৈঠা বেয়ে তীরে যাচ্ছে তখন খলিল বলল, মতি তোর মাথায় কী?
মতি মাথায় হাত দিয়ে মিঠুনের চটচটে চিউয়িংগামটা আবিষ্কার করে। এটাকে টেনে সরানোর চেষ্টা করল এবং যতই চেষ্টা করতে থাকল সেটা ততই ছড়িয়ে যেতে থাকল। নদীর পানিতে ধোওয়ার চেষ্টা করার পর সেটা আরও পাকাপাকি ভাবে চুলে লেগে গেল। তীরে নামার পর খলিল সেটাকে কেরোসিন তেল দিয়ে সরানোর বুদ্ধি দিল। একটু কেরোসিন তেল দেওয়ার পর মাথা থেকে এক ধরনের দুর্গন্ধ বের হওয়া ছাড়া অন্য কোনো লাভ হলো না। খলিল তখন তাকে একটা নাপিতের কাছে নিয়ে গেল। নাপিত পরীক্ষা করে বলল, চুল কেটে ফেলা ছাড়া এটাকে সরানোর কোনো উপায় নেই এবং যত দেরী করা হবে সেটা ততই তার মাথায় ছড়িয়ে যেতে থাকবে। মতি কেন তার মাথায় এই জিনিসটি লাগিয়েছে নাপিত দুর্বল ভাবে সেটা জানতে চেয়েছিল কিন্তু মতির প্রচণ্ড ধমক খেয়ে সে চুপ করে গেল।
মাথা থেকে এক খাবলা চুল চেছে ফেলার পর মতিকে অত্যন্ত অদ্ভুত দেখাতে থাকে। মতি মাথার অন্য অংশ থেকে চুল এনে এই অংশটা ঢেকে রাখার চেষ্টা করল কিন্তু কোনো লাভ হলো না। মতির ধমক খাওয়ার কারণে নাপিত আর কোনো পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করল না। তখন খলিল নিজেই বলল, মতি তুই বরং মাথাটা কামিয়েই ফেল।
মাথা কামিয়ে ফেলব?
এক খাবলা চুল নাই, দেখে মনে হয় চুরি করে ধরা পড়েছিস সেইজন্য কেউ জোর করে চুল কেটে দিয়েছে।
মতি শুনে মেঘ স্বরে বলল, চুপ কর হারামজাদা।
গ্রামের লোকেরা সারা গ্রাম খুঁজেও টিটন আর মিঠুনকে খুঁজে না পেয়ে আবার মাস্টার সাহেবের বাড়িতে একত্র হয়েছে। তার বাড়ির সামনে বড় পুকুর সেই পুকুরের ঘাটে রিতু তিতু এবং টিয়াকে নিয়ে দুশ্চিন্তিত মুখে বসে আছে। কিছুক্ষণ হলো টিয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে। টিয়াকে দেখে তিতুর চোখে পানি টলটল করছে এবং তাদের দুজনকে এভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখে রিতুও কী করবে বুঝতে পারছে না। ঢাকায় তাদের বাবা মাকে জানানো উচিৎ কী না রিতু ঠিক বুঝতে পারছে না। মাস্টার সাহেব তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন, গ্রামের মানুষেরা মিলে টিটন আর মিঠুনকে বের করে ফেলবে, তার কথার উপর ভরসা করে রিতু এখনো তাদের আবু আম্মুদের জানায়নি।
গ্রামের মানুষদের কথা শুনে মাস্টার সাহেব বললেন, সবাই চল, আমরা আজহার আলীর বাড়ি যাই।
গ্রামের মানুষ বলল, চলেন।
তখন প্রায় শখানেক মানুষ দল বেধে আজহার আলীর বাড়িতে রওনা দিল। মিনিট দশেকের মাঝেই তারা আজহার আলীর বাড়ি পৌঁছে যায়।
.
বাড়ির সামনে শদুয়েক মানুষের হই চই শুনে আজহার আলী বের হয়ে এল এক সাথে এত মানুষ দেখে সে ঘাবড়ে যায় কিন্তু মুখে সে সাহসের একটা ভাব ধরে রেখে বলল, কী ব্যাপার, এইখানে এত চিল্লাফাল্লা কিসের?
মাস্টার সাহেব কঠিন মুখে বলল, আপনি খুব ভালো করে জানেন চিল্লাফাল্লা কিসের। উল্টাপাল্টা কথা না বলে সোজাসুজি বলেন ছেলে দুইটারে কোথায় রাখছেন?
আজহার আলী অবাক হবার ভান করল, ছেলে পিলে? কোন ছেলে পিলে? কার ছেলে পিলে?
আপনি জানেন কোন ছেলে পিলে। কার ছেলেপিলে।
আজহার আলী বলল, না আমি কিছু জানি না।
রিতু হাতের চিঠিটা সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল, এই চিঠিটা কে লিখেছে?
আজহার আলী চিঠিটাতে চোখ বুলিয়ে বলল, আমি জানি না, এই চিঠি কে লিখেছে।
রিতু হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিয়ে নিল, তখন আজহার আলী বলল, চিঠি যেই লেখুক অনায্য কথা তো লেখে নাই। আমাগো গেরামে ঝামেলা পাকানোর দরকার কী? অন্যগ্রামে যায় না কেন?
উপস্থিত মানুষেরা চাপা স্বরে প্রতিবাদ করল। মাস্টার সাহেব বললেন, ঝামেলা? এইখানে কোন জিনিসটা ঝামেলা?
আজহার আলী বলল, চিঠিতে লিখেছে পোলাপান চলে গেলেই ছেলে দুইটারে ছেড়ে দিবে। তাহলে পোলাপান যায় না কেন? আমাগো গেরামে কী এমন মধু যে এইখানে থাকতে হবে?
টিয়া তখন হঠাৎ তার রিনরিনে গলায় বলল, আপনি তো চিঠিটা পড়েন নাই, খালি হাতে নিয়ে ফেরত দিয়েছেন। চিঠিতে কী লেখা আছে সেইটা কেমন করে জানলেন?