গাছের নিচে চায়ের দোকান এবং যেটা একই সাথে একটা মনোহারী দোকান। সেখানে গিয়ে দেখা গেল মাস্টার সাহেব এর মাঝে দোকানটাতে পৌঁছে গেছেন। মাস্টার সাহেবের চোখে চশমা এবং চুলে পাক ধরেছে। দোকানের বাঁশের মাচায় বসেছিলেন, রিতুদের দেখে উঠে এলেন। এর মাঝে তিনি পুরো ঘটনাটি শুনেছেন এবারে রিতুর মুখ থেকে আরেকবার শুনলেন, তারপর মুখ কঠিন করে বললেন, এইটা রাজাকার কমান্ডার আজহার আলীর কাজ।
ভীড় করে থাকা মানুষগুলো নিজেদের মাঝে কথা বলছিল হঠাৎ করে সবাই একেবারে চুপ করে গেল। মনে হয় একটা মশা উড়ে গেলেও শোনা যাবে। মাস্টার সাহেব চোখ থেকে চশমা খুললেন, তার পাঞ্জাবির কোনা দিয়ে চশমা পরিষ্কার করলেন তারপর থমথমে গলায় বললেন, আমি যখন কালকে খবর পেয়েছি ঢাকা থেকে কয়েকজন ছেলে মেয়ে এসে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজছে ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য তখনই মনে হয়েছে এই আজহার আলী এইটা নিশ্চয়ই পছন্দ করবে না। এই লোক আমাদের গ্রামে কিছু করতে দেয় না, কেউ একটা গান গাইলে ও বলে ইসলাম গেল ইসলাম গেল।
ভীড়ের অনেকে মাথা নাড়ল। কয়েকজন বিড় বিড় করে কিছু একটা বলল, কী বলল ঠিক বোঝা গেল না।
মাস্টার সাহেব আবার গম্ভীর গলায় বললেন, কালকেই আমার মনে হয়েছিল এই বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলারে একটু সাহায্য করি, গ্রামের মানুষ তাদের সাথে থাকি যেন কেউ কিছু করতে না পারে। কিন্তু তার আগেই দেখো কী হয়ে গেল।
রিতু অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকে রেখে বলল, এখন কী হবে?
মাস্টার সাহেব রিতুর মাথায় হাত রেখে বললেন, তুমি চিন্তা করো না মা। আমরা আছি। গ্রামের মানুষ মিলে আমরা তোমার ভাইদের খুঁজে বের করব।
ভীড় করে থাকা মানুষেরাও মাথা নাড়ল। গলা উঁচিয়ে বলল, খুইজা বার করুম। খোদার কসম।
মাস্টার সাহেব বললেন, মাথা গরম করে লাভ নাই। সবাই বের হয়ে যাও, ভাগাভাগি করে খুঁজতে থাকো। এই গ্রামের এক ইঞ্চি জায়গা বাকি রাখবা না। যদি খুঁইজা না পাই তখন আজহার আলীর বাড়িতে যাব। সবাই রেডি থেকো।
রেডি। আমরা রেডি।
যাও। খুঁজতে থাকো। দেরি করো না।
.
ততক্ষণে অবশ্য দেরি হয়ে গেছে। মতি আর খলিল মিলে মিঠুন আর টিটনকে আজাহার আলীর চিনির বস্তা বোঝাই মহাজনী নৌকার মাঝে আটকে ফেলেছে। গ্রামের মানুষ পুরো গ্রাম তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে কারো মাথায় আসে নাই নদীর মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা বড় বড় মহাজনী নৌকার মাঝে খুঁজে দেখা।
তবে কাজটা মোটেও সহজ হয় নাই। প্রথমত কথা ছিল শুধু মিঠুনকে নিয়ে আসা হবে। ভয় দেখানোর জন্য একটা বাচ্চাই যথেষ্ট। কিন্তু রিতু জোর করে মিঠুনের সাথে সাথে টিটনকে দিয়ে দেওয়ার জন্য মতি আর খলিলের হিসাবে একটু গোলমাল হয়ে গেছে। যে মানুষটা মিঠুন আর টিটনকে ইব্রাহীমের কথা বলে ডেকে নিয়ে গেছে সে এই গ্রামের কেউ না। এই গ্রামের মানুষ হলে তাকে চিনে ফেলতে পারে সেইজন্য অন্য গ্রাম থেকে মানুষ আনা হয়েছে।
যখন জঙ্গলের ভেতর শর্টকাট মারার কথা বলে প্রায় জোর করে টিটন আর মিঠুনকে রাস্তার পাশে জংলা জায়গায় ঢুকিয়ে দেওয়া হলো তখন মতি খপ করে মিঠুনকে আর খলিল টিটনকে ধরে ফেলল। তারা যেন শব্দ করতে পারে সেইজন্য প্রথমেই তাদের মুখ চেপে ধরা হলো। টিটন বেশি ছটফট না করলেও মিঠুন মতিকে ছেড়ে দিল না। লাথি কিল ঘুষি থেকে শুরু করে খামচি কিংবা টান মেরে লুঙ্গি খুলে ফেলা থেকে শুরু করে কামড় দিয়ে কবজি থেকে এক খাবলা গোশত তুলে ফেলা কিছুই বাকি থাকল না। হুটোপুটির সময় মিঠুন যে তার মুখের চিউয়িংগামটা মতির চুলে লাগিয়ে দিয়েছে মতি সেটা তখনো জানে না। শেষ পর্যন্ত খলিল একটা রামদা বের করে টিটনের বুড়ো আঙুল কোপ দিয়ে ফেলে দেবে ভয় দেখানোর পর মিঠুন শান্ত হলো।
মতি তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হাত বুলাতে বুলাতে পাশের গ্রামের ভাড়া করে আনা মানুষটাকে বলল, তোরে না কইলাম একজনরে আনতে, দুইজন আনলি কোন আক্কেলে?
আমি কী আনতে চাইছি? হেই মাতবর মেয়ে জোর করে পাঠাইছে।
খলিল ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল। একদিক দিয়া তো ভালোই হইছে। এইটার আঙুল কাইটা ফালামু বলার পর ইবলিশটারে ঠাণ্ডা করানো গেছে।
মতি তার কনুইয়ের ছাল ওঠা জায়গায় হাত বুলাতে বুলাতে মিঠুনের দিকে বিষ দৃষ্টিতে তাকাল। বলল সেইটা খুব ভুল কথা কইস নাই।
খলিল জিজ্ঞেস করল, এখন কী করুম?
আগে একটা চিঠি লেখ। সেই চিঠিটা ঐ ছেমড়ির হাতে দিতে হইবে। কে লিখব চিঠি?
খলিল বলল, আমার লেখাপড়া হয় নাই, চিঠিপত্র লেখার পারি না।
মতি বলল, একটা চিঠি লিখতে আর কতো লেখাপড়া জানতে হবে?
খলিল বলল, তয় তুমি লিখো না কেন?
মতি বলল, লেখাপড়া করলে তো লিখেই ফেলতাম।
মিঠুন বলল, কাগজ দেন আমি লিখে দেই।
মানুষগুলো মিঠুনের কথা শুনে চোখ কপালে তুলে বলল, এই ছেমড়া তুমি যদি আবার মুখ খুলো দাঁত ভাইঙ্গা দিমু।
মিঠুনের আরো কিছু বলার ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু বলল না। পাশের গ্রামের মানুষটা বলল, ঠিক আছে কাগজটা দেও, আমি লিখে দেই।
তখন সে চিঠিটা লিখল, মিঠুন এবং টিটন বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনলো চিঠিতে কি লিখছে। লিখা শেষ হলে মিঠুন বলল, আমারে একটা কাগজ দিবেন? আমিও একটা চিঠি লিখি।
মতি আবার খেঁকিয়ে উঠল, বলল, খবরদার। কইছি না মুখ খুলবি না।