রিতু অবাক হয়ে বলল, মিঠুন? মিঠুনকে কেন নিয়ে যেতে হবে?
মানুষটা মাথা নাড়ল, বলল, জানি না। ইব্রাহিম সাহেব অপেক্ষা করছেন।
টিয়া বলল, চাচি মনে হয় ঢাকা থেকে ফোন করেছেন।
তিতু বলল, হ্যাঁ হতে পারে। মিঠুনুকে নিয়ে সবাই সব সময় চিন্তা করে।
রিয়া বলল, ঠিক আছে, মিঠুন যা। একা যাবি না, টিটন তুইও সাথে যা।
এবারে মানুষটা খুব ব্যস্ত হয়ে বলল, না,না, একা যেতে বলেছে।
রিতু বলল, একা যেতে বলেছে মানে কী? টিটন সাথে যাক। মিঠুন কোনদিক যেতে কোনদিকে চলে যাবে।
মিঠুন চিউয়িংগাম চিবুচ্ছিল, মুখ থেকে বের করে সেটাকে টেনে লম্বা করে আবার মুখে ঢুকিয়ে বলল, আমি একা যেতে পারব।
তোকে একা যেতে হবে না। আর মুখ থেকে হাত দিয়ে এইভাবে চিউয়িংগাম বের করবি না। ছিঃ।
মিঠুন জিজ্ঞেস করল, কেন? মুখ থেকে চিউয়িংগাম বের করলে কী হয়?
টিয়া বলল, দেখে ঘেন্না লাগে।
মিঠুন বলল, এর সাথে ঘেন্না লাগার কী আছে?
সেইটা যদি না জানিস তোকে মনে হয় আর শেখানো যাবে না।
মানুষটা বলল তাড়াতাড়ি। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
রিতু ভুরু কুঁচকে তাকালো, দেরি হয়ে যাচ্ছে মানে কী? ভাবল মানুষটাকে জিজ্ঞেস করবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করল না। মিঠুন আর টিটনকে বলল তোরা যা। ইব্রাহীম চাচা কী বলে শুনে আয়। সাবধানে যাবি।
মিঠুন মুখের চিউয়িংগামটা আবার টেনে লম্বা করতে করতে হাঁটতে থাকে। টিয়া বলল, ছিঃ মিঠুন! ছিঃ!
মিঠুন আর টিটন মানুষটায় সাথে কিছুদূর হেঁটে যাবার পরই মানুষটা একটা জংলা মতন জায়গার দিকে দেখিয়ে বলল, এখন এইদিকে?
টিটন অবাক হয়ে বলল, কোনদিকে?
এই যে। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে।
জঙ্গলের ভিতর দিয়ে কেন?
শর্ট কাট। বলে মানুষটা দুইজনকে প্রায় টেনে জঙ্গলে ঢুকিয়ে ফেলল এবং কিছু বোঝার আগে হঠাৎ করে দুই পাশ থেকে দুইজন মানুষ তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রথমেই তাদের মুখ চেপে ধরল যেন চিৎকার করতে না পারে। দুইজন হুটোপটি করতে থাকে কিন্তু মানুষগুলোয় গায়ে মোষের মতো জোর টিটন আর মিটুন নড়তেই পারল না।
.
ওদিকে রিতু কেমন যেন দুশ্চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, জিনিসটা ভালো লাগছে না।
তিতু জিজ্ঞেস করল, কোন জিনিসটা?
এইযে হঠাৎ করে ইব্রাহীম চাচাকে ডেকে পাঠাল। ঠিক তখন আরেকজন এসে বলল, মিঠুনকে ডাকছে। পুরো ব্যাপারটা জানি কেমন।
টিয়া বলল, কেমন আবার কী?
মিঠুন আর টিটনকে যেতে দেওয়া ঠিক হয় নাই।
কেন?
জানি না। কিন্তু মনে হচ্ছে কাজটা ঠিক হয় নাই।
টিয়া বলল, আপু তুমি শুধু শুধু বেশি চিন্তা করো।
কিন্তু কয়েক মিনিটের মাঝে দেখা গেল রিতু শুধু শুধু বেশি চিন্তা করে না, তার চিন্তা করার সত্যিকারের একটা কারণ আছে। ছোট একটা ছেলে একটা লজেন্স খেতে খেতে কোথা থেকে জানি তাদের কাছে হাজির হলো। ছেলেটা লজেন্স চুষতে চুষতে বলল, ঐ স্যার আমারে এই লজেন্সটা দিছে।
একজন স্যার তাকে একটা লজেন্স দিয়েছে সেটা কেন ছেলেটা তাদেরকে বলছে রিতু বুঝতে পারল না। তখন দেখল তার হাতে ভাজ করা একটা কাগজ। ছেলেটা কাগজটা তাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, স্যার বলছে তোমাগো এই কাগজটা দিতে।
রিতুর বুকটা ধ্বক করে উঠল। সে কাগজটা হাতে নিয়ে ভাঁজ খুলে তাকালো, সেখানে খুবই খারাপ হাতে লেখা:
এই চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে তুমরা আমাগো গেরাম তেকে বিদায় হও। যদি বিদায় হও তাইলে তুমাদের ভাইগো ছেড়ে দিমু।
যদি বিদায় না হও তাহলে পরতি ঘণ্টায় একটা করে আঙুল কাটি ফেলমু।
–তুমাগো আজরাইল।
রিতুর হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
তিতু বলল, আমরা কেন এই গ্রাম থেকে বিদায় হব? আমরা কী করেছি?
টিয়া বলল, এইটুকু চিঠিতে আটটা বানান ভুল।
১০. যখন সবাই আতংকিত
১০. যখন টিটন আর মিঠুনকে কিডন্যাপ করে সবাইকে আতংকিত করে ফেলেছে।
রিতু মনে মনে আশা করেছিল যে মিঠুন আর টিটন আসলে ইব্রাহীম চাচার সাথেই আছে, অশিক্ষিত একটা মানুষ মিছি মিছি তাদের ভয় দেখাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু যখন সে দেখল গেস্টহাউজ থেকে ইব্রাহীম চাচা একা লম্বা লম্বা পা ফেলে প্রায় ছুটে আসছে তখন সে বুঝল আসলে তারা সত্যি সত্যি বড় বিপদে পড়েছে। তাদের আল্লু আম্মুরা যে তাদের প্রথমে আসতে দিতে চাননি তার কারণটা এখন সে হঠাৎ করে বুঝতে পারে।
ইব্রাহীম রিতু তিতু আর টিয়ার কাছে এসে তাদের কাছ থেকে খবর নিল, তারপর ভুল বানানে লেখা অশিক্ষিত মানুষের চিঠিটা কয়েকবার পড়ল। রিতু দেখতে পেলো দেখতে দেখতে ইব্রাহীমের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। গ্রামের রাস্তায় মানুষজন খুব কম, যে কয়জন এসেছে ইব্রাহীম তাদের সবাইকে জিজ্ঞেস করল তারা আট বছর আর বারো বছরের দুইজন কমবয়সী ছেলেকে দেখেছে কী না। কেউ দেখেনি। কথা শেষ করে কোনো মানুষই চলে গেল না, তারা সবাই দাঁড়িয়ে রইল এবং দেখতে দেখতে গ্রামের অনেক মানুষের ভীড় হয়ে গেল। দুইজন বাচ্চাকে কিডন্যাপ করে অন্যদেরকে গ্রাম ছেড়ে চলে দেওয়ার জন্য হুমকি দিয়েছে ব্যাপারটা গ্রামের কোনো মানুষ মেনে নিতে পারছে না। গ্রামের মানুষেরা এটা তাদের গ্রামের জন্য একটা কলংক হিসেবে মনে করছে।
তখন তখনই কম বয়সী অনেকেই গ্রামের এদিকে সেদিকে গিয়ে টিটন আর মিঠুনকে খোঁজাখুজি শুরু করল। তবে বেশিরভাগ মানুষই কী করা উচিৎ ছিল সেই ব্যাপারে বড় বড় লেকচার দিতে থাকল। বয়স্ক কয়েকজন মানুষ এখন কী করা উচিৎ সেটা নিয়ে নিজেদের মাঝে কথা বলে ঠিক করল সবার আগে তাদের মাস্টার সাহেবের সাথে পরামর্শ করা দরকার। মাস্টার সাহেব এই গ্রামের মান্যগণ্য মানুষ, কাছাকাছি একটা প্রাইভেট কলেজে বাংলা পড়ান। তখন তখনই একজন মাস্টার সাহেবকে খবর দেওয়ার জন্য ছুটে গেল। অন্যরা রিতুদের নিয়ে মাস্টার সাহেবের বাড়ির দিকে রওনা দিল।