সবাই মাথা নাড়ল, বলল জানি।
কাজেই বুঝে গেলাম এই ইদরিস মিয়াই আমাদের ইদরিস মিয়া।
টিয়া জিজ্ঞেস করল, উনি কী করেন?
ঠিক নাই। কখনো রিকশা চালান। কখনো মাটি কাটেন। নদীর পাড়ে ছোট একটা চালা ঘরের মতো তৈরি করে সেখানে থাকেন। বিকাল বেলার দিকে বের হয়ে জঙ্গলের দিকে যান।
কেন?
কেউ জানে না। এক দুইজন বলেছে সেখানে গিয়ে একটা গাছের নিচে বসে থাকেন। পাগল কিসিমের মানুষ।
সবাই চুপ করে রইল। ইব্রাহীম চাচা আগে কখনো কথা বলে নাই। এখন যখন শেষ পর্যন্ত তার মুখ খুলানো গেছে কথা বলতেই থাকল, বলল, তার সাথে যারা থাকে তারা বলেছে ইদরিস মিয়া কথা বলে খুব কম কিন্তু যখন কথা বলে খুব শান্তভাবে ধীরে সুস্থে কথা বলে। সুন্দর ভাষায় কথা বলে। এই জায়গা ছেড়ে কোথাও যায় না। মাঝে মাঝে কয়েকদিনের জন্য যদি যায় তাহলে আবার ফিরে আসে।
বাচ্চারা নিজেদের ভিতর এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করে। এখনো কাউকে বলে নাই যে তারা আসলে এসেছে তাদের দাদা কিংবা নানার খোঁজ নিতে। সেটা তারা গোপন রাখতে চায়। যখন তারা ইদরিস মিয়ার সাথে কথা বলবে তখন চেষ্টা করবে ইব্রাহীম চাচা যেন আশে পাশে না থাকে।
ইব্রাহীমের মনে হয় হঠাৎ করে কথা বলার রোগ হয়েছে। সে মুগের ডাল দিয়ে পরটা খাওয়া বন্ধ করে আবার কথা বলা শুরু করল, যার সাথেই যোগাযোগ করেছি, সেই বলেছে ইদরিস মিয়া কারো সাথে কথা বলতে চায় না। একবার নাকী একজন সাংবাদিক তার সাথে কথা বলতে এসেছিল, ইদরিস মিয়া একটা কথাও বলে নাই।
তিতু ভয়ে ভয়ে বলল, আমাদের সাথেও কথা বলবেন না?
ইব্রাহীম চাচা বলল, জানি না। গিয়ে তোমাদের নিজেদের চেষ্টা করতে হবে।
রিতু জিজ্ঞেস করল, আমরা কখন যাব?
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আমি এক কাপ চা খেয়ে নেই। তোমরা জামা কাপড় পরে আস।
বাচ্চারা যখন জামা কাপড় পরে নেমে এসেছে তখন তারা যদি ভালো করে লক্ষ্য করতো তাহলে দেখতে গেস্টহাউজের সামনে একটা বড় গাছে হেলান দিয়ে বসে থাকা একজন মানুষ তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে সাইকেল চালিয়ে গ্রামের দিকে ছুটে যাচ্ছে।
সবাই মিলে তিনটা রিকশা করে রওনা দিয়েছে। প্রথম রিকশায় রিতু আর মিঠুন। মিঠুনকে সামলানোর জন্য রিতুকে সব সময় আশেপাশে থাকতে হয়। পরের রিকশাতে টিটন রিতু আর টিয়া। সবার শেষে একটা রিকশায় ইব্রাহীম।
রিকশা করে মিনিট দশেক যাওয়ার পর মিঠুন চলন্ত রিকশা থেকে তড়াক করে লাফ দিয়ে নিচে নেমে গেল। বলল, রিকশাতে ঝাঁকুনির চোটে তার ইয়ে ঢিলে হয়ে যাচ্ছে। ইয়েটা কী জিজ্ঞেস করার পরও সেটা সে ব্যাখ্যা করতে রাজি হলো না দেখে কেউ আর চাপাচাপি করল না। কখন কী বলতে গিয়ে মিঠুন কী বলে ফেলে সেটা নিয়ে সবাই ভয়ে ভয়ে থাকে। মিঠুন বলল, সে রিকশায় পাশে পাশে হেঁটে হেঁটে যাবে। রাস্তা এত খারাপ যে সত্যি সত্যি রিকশায় না গিয়ে হেঁটে হেঁটেই তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে।
তখন অন্যরাও বলল যে তারাও হেঁটে হেঁটে যাবে। এই পুরো পথ রিকশায় গেলে হয় রিকশা ভেঙ্গেচুরে যাবে না হয় তাদের হাড়গোড় ভেঙ্গেচুরে যাবে। তখন রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সবাই হেঁটে হেঁটে যেতে লাগল।
এভাবে যখন তারা আরো কিছুদূর গিয়েছে তখন হঠাৎ ইব্রাহীমের ফোন বেজে উঠল। ইব্রাহীম ফোনটার দিকে তাকাল একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে কেউ তাকে ফোন করেছে। সে ফোনটা কানে লাগাল অন্য পাশ থেকে কেউ কথা বলল এবং সেটা শুনে তার ভুরু কুঁচকে উঠল, বলল, কে দেখা করতে চাইছে? অন্যপাশ থেকে কিছু একটা বলল এবং ইব্রাহীমের ভুরু আরো কুঁচকে উঠল, বলল, এখনই? সন্ধ্যাবেলা হলে হয় না?
ইব্রাহীম আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা বন্ধ করে অন্যদের দিকে তাকালো। বলল, আমার একটু গেস্টহাউজে যেতে হবে।
রিতু জিজ্ঞেস করল, কেন?
লোকাল পুলিশ থেকে একজন এসেছে সে কথা বলতে চায়।
কী নিয়ে কথা বলবে?
জানি না। খুবই নাকী জরুরি। আমি একটু শুনে আসি।
আমরা তাহলে আস্তে আস্তে হাঁটি?
ইব্রাহীমকে একটু বিভ্রান্ত দেখাল, তারপর বলল, ঠিক আছে তোমরা এই রাস্তা ধরে আস্তে আস্তে হাঁটো আমি যাব আর আসব।
ইব্রাহীম পা চালিয়ে গেস্টহাউজের দিকে রওনা দিল। গেস্টহাউজে পৌঁছতে তার মিনিট দশেক লাগল। গিয়ে দেখে সেখানে কেউ নেই। গেস্টহাউজের কেয়ারটেকার জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল তারা মোটেও তাকে ফোন করেনি। পুলিশ থেকেও কেউ আসে নাই। কেউ তার সাথে কথা বলতে চায় নাই। হঠাৎ করে ইব্রাহীম দুশ্চিন্তিত হয়ে যায়। কোনো একজন তাকে বাচ্চাদের থেকে সরিয়ে নিয়েছে। তাহলে কী তারা বাচ্চাদের কিছু করতে চায়? সময়টা ভালো না, এখানে আজহার আলী নামে একজন রাজাকার কমান্ডার থাকে, মুক্তিযুদ্ধ শব্দটাতেই তার অ্যালার্জি। সে কী বাচ্চাদের কোনো ক্ষতি করতে চায়? হতে পারে এই সরকার রাজাকারের পক্ষের সরকার তাই বলে ছোট বাচ্চাদের কিছু করার দুঃসাহস তাদের হবে? ইব্রাহীম পা চালিয়ে বাচ্চাদের কাছে ফিরে যেতে থাকে।
সে অবশ্যি তখনো জানে না যে যা হবার তা এর মাঝে হয়ে গেছে।
.
ইব্রাহীম চলে যাবার কিছুক্ষণ পরেই একজন মানুষ ছেলেমেয়েদের কাছে। এল। বলল, আমাকে ইব্রাহীম সাহেব পাঠিয়েছেন।
রিতু জানতে চাইল, কেন?
ইব্রাহীম সাহেব বলেছেন মিঠুনকে নিয়ে যেতে।