যারা শুধু বাইরে থেকে এই বাসাটি দেখে চোখ কপালে তুলে চলে যায় তারা অবশ্য কল্পনাও করতে পারবে না বাসার ভেতরে কী ঘটছে। তবে তারা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারবে, ভেতরের মানুষগুলো নিশ্চয়ই খুব বিচিত্র। তা না হলে একটা বাসায় এরকম ঘটনা কেমন করে ঘটতে পারে। তাদের ধারণা সত্যি, এই বাসার ভেতরের মানুষগুলো বাসাটির মতোই বিচিত্র।
এই বাসায় রাহেলা খাতুন তার ছেলেমেয়ে আর নাতি নাতনিদের নিয়ে থাকেন। জমিটা তার স্বামী বহু বছর আগে কিনে রেখে গিয়েছিলেন। কোনোদিন এখানে ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকতে পারবেন ভাবেননি। তার প্রধান কারণ জমিটা যখন প্রথম কেনা হয় তখন সেটা ছিল সাতফুট পানির নিচে। কোনো একদিন সেটা ভরাট করা হবে এবং সেখানে বাড়িঘর করা হবে কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। রাহেলা খাতুনের স্পষ্ট মনে আছে তিনি কীভাবে তার এই জমিটা দেখতে গিয়েছিলেন।
রাহেলা খাতুনের স্বামীর নাম ছিল আসাদ রহমান, সরকারি ব্যাংকে ছোট একটা চাকরি করতেন। তাদের খুব টানাটানির সংসার, বিয়ের পর দেখতে দেখতে তিনটা বাচ্চা হয়ে গেছে। এর মাঝে আসাদ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে কোন দুনিয়ায় একটা জমি কিনে ফেললেন। জমি কেনার পর থেকে তার উৎসাহে মাটিতে পা পড়ে না। তাই একদিন রাহেলা খাতুনকে সেই জমি দেখাতে নিয়ে গেলেন। রাহেলা খাতুন তার একমাত্র সিল্কের শাড়ি পরে সেজে গুঁজে জমি দেখতে গেলেন। সাথে তার তিন ছেলে মেয়ে। বড়জন ছেলে, নাম মাসুদ, তার বয়স পাঁচ, দ্বিতীয়জন মেয়ে, নাম মিলি, তার বয়স তিন এবং ছোটজন ছেলে, নাম মতিন, বয়স মাত্র এক।
প্রথমে বাসে করে যেতে হলো এবং বাসে বমি করতে করতে বড় ছেলেটি নেতিয়ে গেল। বাস থেকে নেমে রিকশা, রিকশা থেকে নেমে পায়ে হেঁটে যেতে হলো আরো কয়েক কিলোমিটার। রাহেলা খাতুনের কোলে ছোট জন, বড় দুইজন আসাদের সাথে, একজন ঘাড়ে আরেকজন কোলে। কাদামাটির রাস্তায় পিছল খেতে খেতে হেঁটে একটা বিশাল জলাভূমির সামনে দাঁড়িয়ে আসাদ বললেন, এই যে আমাদের জমি।
রাহেলা খাতুন বললেন, জমি কোথায়? এইটা তো দেখি পানি।
আসাদ বললেন, সেই জন্যেই তো সস্তায় পেয়ে গেলাম। শুকনা হলে কী আমার মতন মানুষ জমি কিনতে পারে?
রাহেলা খাতুন মাথা নাড়লেন, আসাদ এই কথাটা সত্যি বলেছে। জিজ্ঞেস করলেন, কোনখানে আমাদের জমি?
আসাদ মাথা চুলকে বললেন, শীতের সময় যখন পানি নেমে যাবে তখন দেখা যাবে। এখন পানির নিচে।
তবুও তো জায়গাটা দেখি। কোন জায়গায় পানির নিচে?
আসাদ আবার মাথা চুলকালেন, তারপর হাত তুলে দেখিয়ে বললেন, ঐ যে মাদারগাছটা দেখছো, মনে কর তার কুড়ি গজ দক্ষিণে।
রাহেলা খাতুন মাদারগাছ চিনেন না, কুড়ি গজ কতটুকু সেটা আন্দাজ করতে পারেন না, উত্তর দক্ষিণ কোন দিকে হয় সেটাও জানেন না কাজেই কিছুই বুঝলেন না। তবুও স্বামীকে খুশি করার জন্য বললেন, ও! বুঝেছি।
ঠিক তখন সেই পানির উপর দিয়ে একটা কাক উড়ে যাচ্ছিল এবং উড়ে যেতে যেতে সেই কাক পানিতে বাথরুম করে ফেললো। আসাদ তখন মহা উৎসাহে বললেন, দেখেছ? দেখছ? কাকটা যে বাথরুম করেছে দেখেছ?
রাহেলা খাতুন মাথা নাড়লেন, বললেন, দেখেছি।
যেখানে বাথরুম হয়েছে সেখানে আমাদের জমি।
আসাদ হাসি হাসি মুখে সাতফুট পানির নিচে তার জমির দিকে তাকিয়ে রইলেন। রাহেলা খাতুনকে বললেন, বুঝলে রাহেলা, নিজের এক টুকরা জমি থাকতে হয়। সেই মাটির উপর একটা ছাদ তৈরি করে এক ছাদের নিচে সবাইকে থাকতে হয়।
রাহেলা খাতুনের একবার মনে হলো আসাদকে মনে করিয়ে দেন যে মাটির কোনো নিশানা নাই, পুরোটাই পানির নিচে কিন্তু তিনি সেটা করলেন না। মানুষটা এত উৎসাহ নিয়ে দেখাচ্ছে এখন এই সব ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানো ঠিক হবে না। আসাদ কাকের বাথরুম করা পানির দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, একদিন আমি এইখানে বাড়ি তুলবো। সাত তালা বাড়ি। সেই সাত তালার নিচ তলায় থাকব তুমি আর আমি। দুই বুড়াবুড়ি। আর একেক তালায় থাকবে আমাদের একেক ছেলে মেয়ে।
রাহেলা খাতুন ভয়ে ভয়ে বললেন আমাদের ছেলে মেয়ে তো তিনজন।– আসাদ এক গাল হেসে বললেন, এখন তিনজন বলে সবসময় তিনজনই থাকবে নাকী? আমাদের আরো বাচ্চা কাচ্চা হবে না?
আরো হবে?
হ্যাঁ। কম পক্ষে ছয় জন। ঘর ভর্তি বাচ্চা কাচ্চা না হলে ভালো লাগে না।
ঠিক এই সময় তাদের বড় ছেলে মাসুদ রাহেলা খাতুনের শাড়ির আঁচল টেনে বলল মা।
রাহেলা খাতুন বললেন, কী হয়েছে?
মিলি-
মিলি তার মেয়ের নাম। জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে মিলির?
মিলি নাই।
রাহেলা খাতুন চমকে তাকিয়ে দেখেন সত্যি সত্যি মিলি নাই। তার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল, আতংকে চিৎকার দিয়ে বললেন, কোথায় মিলি?
মাসুদ বরাবরই শান্ত স্বভাবের। সে খুবই শান্তভাবে পানির দিকে তাকিয়ে বলল, ঐ যে।
রাহেলা খাতুন দেখলেন, সামনে খোলা পানি সেখানে মিলি ডুবে যাচ্ছে। রাহেলা খাতুন সাথে সাথে পানিতে ঝাঁপ দিলেন।
তার কোলে ছিল ছোট ছেলে মতিন, তাকে মাটিতে রেখে নাকী তাকে নিয়েই পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন তার মনে নাই। তার চেয়ে বড় কথা তিনি যে সাঁতার জানেন না তখন সেটাও তার মনে ছিল না। ভাগ্যিস সেখানে বেশি পানি ছিল না তাই মিলিকে টেনে তুলে ফেলেছিলেন, আসাদ তখন তাদের দুজনকে টেনে তুললেন। মিলি খক খক করে কাশতে লাগলো, রাহেলা খাতুন তার চুলের মুঠি ধরে ঝাকুনী দিয়ে বললেন, পাজি মেয়ে, তোকে পানির কাছে যেতে কে বলেছে?