সুলতান কিছু বলল না। মফিজ হুঁকো ধরিয়ে গুড়ক গুড়ক করে। কয়েকটা টান দিয়ে শরীরটা গরম করে নিয়ে সেটা সুলতানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও সুলতান ভাই। কয়টা টান দিয়ে নাও।
সুলতান হুঁকোটা দেখে আরো পিছিয়ে গেল হুঁকো খেতে চাইল না। তখন মফিজ খুব অবাক হলো, এই শীতের রাতে একজন হুঁকোয় দুটো টান দিতে চাইবে না সেটা বিশ্বাস করা শক্ত। কিন্তু যদি কেউ হুঁকো খেতে চায় না তখন তো আর জোর করা যায় না।
মফিজ মাছ মারার সরঞ্জামগুলো নিয়ে নেয়। একটা গোল জাল, একটা কোচ আর মাছ ধরার জন্য পলো। কোচ হচ্ছে বর্শার মতো, তবে বর্শার ফলা থাকে একটা, কোচের ফলা অনেকগুলো।
ঘরের দরজা বন্ধ করে মফিজ বের হয়ে আসে। সুলতান সাথে সাথে হাঁটতে শুরু করে, মফিজ পিছু পিছু হটে। নিশুতি রাত কুয়াশায় ঢাকা। গ্রামের পথ দিয়ে দুজন হেঁটে যাচ্ছে দুই পাশে গাছ গাছালি, উপরে তারা ঢাকা একটা আকাশ। মফিজ জোরে জোরে হাঁটে কিন্তু সুলতানকে ধরতে পারে না। সে সামনে দিয়ে আরো জোরে হাঁটে, কিছুতেই তাকে ধরা যায় না। সবচেয়ে আশ্চর্য হচ্ছে সুলতান যে এত জোরে হাঁটছে তার পায়ের কোনো শব্দ নেই, সে একেবারে নিঃশব্দে হেঁটে যাচ্ছে।
যাই হোক দুজনে হেঁটে খালের ধারে পৌঁছেছে। সেখানে নৌকাটা বাধা আছে। সুলতান নৌকার গলুইয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে বসল। মফিজ মাছ ধরার সরঞ্জাম নৌকার মাঝখানে রেখে নৌকাটাকে ধাক্কা দিয়ে পানির ভিতর নামিয়ে লাফিয়ে নৌকার উঠে বৈঠা বাইতে শুরু করল।
শীতের রাত ছপাৎ ছপাৎ করে বৈঠা বেয়ে মফিজ খাল বেয়ে নৌকা নিয়ে যায়। খাল থেকে নৌকা নদীতে পড়ল, নদী থেকে বাঘমারা বিলে। বিলের ভেতর নৌকা ঢুকিয়ে মফিজ লগি দিয়ে নৌকা নিয়ে যায়। নৌকার গলুইয়ে সুলতান চুপচাপ বসে আছে, সে কোনো কথা বলে না, কোনো শব্দ করে না।
বিলের মাঝখানে নৌকাটা নিয়ে মফিজ মাছ ধরতে শুরু করল। জাল ফেলে সেটা টেনে তুলতে পারে না। জালে এতো মাছ ধরেছে। মাছগুলো নৌকায় পাটাতনে ফেলে সে আবার জাল ফেলল। তারপর আবার। দেখতে দেখতে নৌকা প্রায় মাছে বোঝাই হয়ে যাবার অবস্থা।
এরকম সময় মফিজ কেমন যেন খচমচ শব্দ শুনতে পায়, মনে হতে থাকে মাছগুলো যেন কেউ কচমচ করে খাচ্ছে। নৌকার মাঝে মাছ কে খাবে? মফিজ বেশি গুরুত্ব দিল না সে মাছ মেরেই চলল।
তখন হঠাৎ করে তার মনে হলো আশেপাশে কেমন যেন ফিস ফিস শব্দ, মনে হচ্ছে কেউ ফিস ফিস করে কথা বলছে। সে মাথা ঘুরিয়ে সুলতানের দিকে তাকাল এবং সাথে সাথে তার শরীর হিম হয়ে গেল। সে দেখল চাদর মুড়ি দেওয়া মানুষটি, যাকে সে এতক্ষণ সুলতান ভেবে আসছে। সে মোটেও সুলতান নয়। সে তার লম্বা কালো হাত বাড়িয়ে এক সাথে অনেকগুলো মাছ ধরে মুখের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যায় না কিন্তু সেই প্রাণীটার অনেক বড় একটা মুখ, সেই মুখে মাছগুলো ঢুকিয়ে কচমচ করে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে।
এতক্ষণ চাদর দিয়ে মুখ মাথা ঢেকে রেখেছিল, এখন চাদর খসে পড়েছে, প্রাণীটার মাথা দেখা যাচ্ছে। এমনিতে অন্ধকার কিন্তু তারার আলোতে আবছা দেখা যায় প্রাণীটার বড় একটা মাথা। চোখগুলো লাল অঙ্গারের মতো জ্বলছে। নাক নেই সেখানে দুটো গর্ত, আর অনেক বড় একটা মুখ। মুখের ভিতর থেকে লকলকে একটা জিব বের হয়ে আসছে সেই জিব টান দিয়ে মাছগুলোকে মুখের ভিতর নিয়ে যাচ্ছে। যখনই মুখ খুলছে একটা পচা গন্ধ বের হয়ে আসছে, পুরো নৌকায় পচা একটা গন্ধ।
মফিজ যত মাছ ধরেছিল প্রাণীটা সব মাছ খেয়ে ফেলে মুখ দিয়ে এক ধরনের শব্দ করছে। মনে হচ্ছে আরো মাছ খেতে চায়। কিন্তু মফিজের তখন আর মাছ ধরার ক্ষমতা নাই। সে বিস্ফারিত চোখে প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে আছে। তার সমস্ত শরীর কুল কুল করে ঘামছে। অন্ধকার নির্জন বিল তার মাঝে সে একা।
প্রাণীটা হঠাৎ উঠে দাঁড়াল, শরীর থেকে চাদরটা খসে পড়েছে। বড় মাথা, মাথায় কোনো চুল নাই, লম্বা লম্বা হাত, উঁচু কাঁধ। পাগুলো খাটো। প্রাণীটা থপ থপ করে পা ফেলে মফিজের দিকে এগিয়ে আসে। মফিজ বুঝতে পারে মাছ খেয়ে প্রাণীটার খিদে মিটেনি, সে এখন আরো খাবে।
মফিজ তখন হাত বাড়িয়ে কোচটা তুলে নেয়। তারপর সেটা হাতে নিয়ে প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে থাকে। জান্তব একটা শব্দ করে প্রাণীটা দুলতে দুলতে এগিয়ে আসতে থাকে, যখন আরেকটু কাছে এসেছে তখন মফিজ কেঁচটা তুলে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রাণীটাকে সেখানে গেঁথে ফেলল।
প্রাণীটা অমানুষিক একটা চিৎকার করে ছটফট করতে থাকে, কোচ থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে, কিন্তু মফিজ সেটাকে ছাড়ল না, কোচের মাথায় ধরে রেখে প্রাণীটাকে নৌকায় পাটাতনে ঠেসে ধরে রাখল।
কতক্ষণ ধস্তাধস্তি করছিল মনে নেই হঠাৎ মনে হলো কা কা করে একটা কাক ডাকছে, মফিজ অবাক হয়ে দেখল কোচের আগায় কোনো ভয়ংকর প্রাণী নেই, একটা বড় দাঁড়কাক সেখানে গেঁথে আছে। কা কা শব্দ করতে করতে কাকটা মরে গেল।
মফিজ অবাক হয়ে কাকটার দিকে তাকিয়ে রইল। ভয়ে আর আতংকে তার শরীর থর থর করে কাঁপতে থাকে। এরপর তার আর কিছু মনে নেই।
পরদিন মানুষজন বাঘমারা বিল থেকে মফিজকে উদ্ধার করল। আসল সুলতান মাছ মারার জন্য মফিজের বাড়ি গিয়ে দেখে মফিজ নাই। তখনই তার কিছু একটা সন্দেহ হয়েছে। দিনের আলো হলে লোকজন নিয়ে বাঘমারা বিলে গিয়ে দেখে সত্যিই একটা নৌকা ভেসে বেড়াচ্ছে। নৌকার পাটাতনে মফিজ অজ্ঞান হয়ে আছে। মুখে ফেনা, সারা শরীর থেকে পিচ্ছিল এক ধরনের তরল বের হচ্ছে। মফিজ তখনো কোচটা ধরে রেখেছে, কেঁচের মাঝে গেঁথে রেখেছে একটা মরা কাক।